কাজ হাওরে, স্বীকৃতি বিদেশে

হবিগঞ্জের শিবপাশায় গ্রামীণ দুই নারীকে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দিচ্ছেন আজিজা বেগম (বাঁয়ে) l প্রথম আলো
হবিগঞ্জের শিবপাশায় গ্রামীণ দুই নারীকে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দিচ্ছেন আজিজা বেগম (বাঁয়ে) l প্রথম আলো

কর্মস্থল প্রত্যন্ত ভাটি (হাওর) অঞ্চলের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। যোগদানের প্রথম দিনই তাঁর মন খারাপ। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। নেই লোকবল, উপকরণ। কাছাকাছি নেই নিজের থাকার ব্যবস্থাও। কেন্দ্রের একেবারে পাশের মানুষও আসেন না চিকিৎসাসেবা নিতে। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তোলে তাঁকে।
বাড়ির পাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও লোকজন সেবা নিতে না আসায় একসময় তিনিই বাড়ি বাড়ি শুরু করেন ছোটাছুটি। বোঝাতে থাকেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার সুবিধার বিষয়ে। এভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্যসুবিধা পৌঁছে দেওয়ার নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। নাম আজিজা বেগম।
হবিগঞ্জের এই কৃতী স্বাস্থ্যকর্মীর সেবার সুনাম এখন কেবল অজপাড়াগাঁতেই থেমে নেই। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশেও। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক শিশু স্বাস্থ্যসেবা পুরস্কার (গ্লোবাল চাইল্ড সার্ভিস)। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দিয়েছে।
যেভাবে উঠে আসা: হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চল আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী আজিজা বেগম। সরকারি স্বাস্থ্য কর্মসূচির সহায়তার জন্য ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত মা-মণি প্রকল্পে ২০১১ সালে নিয়োগ পান তিনি। এর আগে কাজ করেন বেসরকারি সংস্থা সূর্যের হাসি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গ্রামীণ কল্যাণ কেন্দ্রে। ২০ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা পেশায় জড়িয়ে আছেন তিনি।
নরসিংদীর গংশিরদিয়া গ্রামে জন্ম আজিজার। ১৯৮৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন তিনি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে ফল ভালো না হওয়ায় বন্ধ করে দেন পড়াশোনা। অবশ্য কয়েক বছর পর ১৯৯২ সালে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্যারামেডিক কোর্স করেন। নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন স্বাস্থ্যসেবায়।
আজিজা জানান, শিবপাশা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগদানের প্রথম দিনই এর অবস্থা দেখে ভাবনায় পড়েন তিনি। এক কিলোমিটার দূরে এক ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। প্রতিদিন হেঁটে অফিস করতেন। প্রথম প্রথম অফিসে গিয়ে একা বসে থাকতেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লোকজনকে টেনে আনতে কী করা যায়, তা ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনা থেকেই একসময় বাড়ি বাড়ি ছুটে যাওয়া।
আজিজা আরও জানান, প্রথম দিকে মাসে ছয়-সাতজনের বেশি অন্তঃসত্ত্বা মা সেবা নিতে আসতেন না। এক বছরে তা ৩০-৩৫ জনে পৌঁছায়। দুই বছর পর ৪৫ জনে। এভাবে লোকজন আসা শুরু করলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন করে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ও আয়া। তাঁর যোগদানের পর থেকে (২০১১ সালের ১২ অক্টোবর) গত বৃহস্পতিবার এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক হাজার মায়ের সন্তান প্রসব করানো হয়। তিনি একাই করেছেন ৫০০ মায়ের। ইউনিয়নের প্রায় ২৮ হাজার মানুষ এখন প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা এ কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন।
এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শ, স্বাভাবিক প্রসবসেবা, সন্তান জন্মদান-পরবর্তী সেবা, এম আর করানো, নবজাতকদের স্বাস্থ্যসেবা ও ইপিআই দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি গুরুতর রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে জেলা আধুনিক হাসপাতালে পাঠানোসহ সাধারণ সব চিকিৎসাসেবাই দেওয়া হচ্ছে।
অর্জন: আজিজা বেগমের যোগ দেওয়ার এক বছরের মধ্যেই ২০১২ এবং ২০১৩ সালে সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ নিরাপদ প্রসবসেবা কেন্দ্র নির্বাচিত হয় শিবপাশা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এ স্বীকৃতি দেয়।
এরপর গত বছরের ১৯ নভেম্বর আজিজা পেয়েছেন আন্তর্জাতিক শিশু স্বাস্থ্যসেবা পুরস্কার। ওই দিন নিউইয়র্কের একটি হোটেলে তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ।
স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়া: কোনো কাজ আন্তরিকভাবে করলে স্বীকৃতি অবশ্যই মিলবে বলে মনে করেন আজিজা। আন্তর্জাতিক ওই পুরস্কার গ্রহণ করার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যখন মঞ্চে উঠি তখন আমার বক্তৃতা ও পোশাক উপস্থিত সবারই নজর কাড়ে। পুরস্কার গ্রহণকালে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং অভিনেতা বেন অ্যাফ্লেক তাঁর পাশে বসে ছিলেন।’
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজে স্বীকৃতি পেলেও কিছুটা ক্ষোভ তাঁর রয়েই গেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যতই পুরস্কার পাই না কেন দুঃখ লাগে, নিজের দেশ থেকে কোনো সম্মান না পাওয়ায়।’ তিনি বলেন, সরকার স্বাস্থ্য খাতে বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগ দেয়। এরপর তাঁরা কী করেন, সেই খবর আর রাখে না। কাজের তদারকি না থাকায় বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
স্থানীয়দের কথা: এলাকার বাসিন্দা সাইদুল আমিন চৌধুরী বলেন, আজিজা বেগম দায়িত্ব নেওয়ার পর এলাকার মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, যেখানে আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেউ যেতেন না, সেখানে এখন দিনরাত রোগীরা যান। তাঁরা আজিজাকে উপস্থিত পান। তাঁর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। অন্যদের কথাতেও পাওয়া যায় সাইদুলের এ কথারই প্রতিধ্বনি।
কর্মকর্তাদের ভাষ্য: মা-মণি প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (অপারেশন রিসার্চ) মারুফা আজিজ খানের কথায়, আজিজা বেগম আন্তর্জাতিকভাবে যে সম্মান বয়ে এনেছেন, তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য ইতিবাচক। তা-ও একজন মাঠপর্যায়ের কর্মী এটি পাওয়ায় তাঁরা খুশি।
জেলা সিভিল সার্জন নাসির উদ্দিন ভূঞা বলেন, ‘আজিজার এই স্বীকৃতিতে আমরা গর্বিত। এই জেলার আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন আজমিরীগঞ্জের মানুষ। স্বাস্থ্য খাতে সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ ভাগ উন্নয়ন করা। অথচ এ উপজেলায় এখনই ৫৪ ভাগ অর্জন করেছে।’