বিসিএসে প্রথম হয়েও চাকরি পাননি আউয়াল

২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি পাননি কুমিল্লার আবদুল আউয়াল। তবে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বা চাকরি না পাওয়ার কারণ—কোনো কিছুই জানানো হয়নি তাঁকে। সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে তিনি তাঁর প্রথম হওয়ার তথ্যটি জানতে পারেন।
এই সূত্রে অনুসন্ধানে নেমে জানা গেল, আউয়ালের ২৯তম বিসিএসের প্রার্থিতাই বাতিল করা হয়েছে এবং সরকারি চাকরিতে তাঁকে নিষিদ্ধ করেছে পিএসসি। তবে কেন এবং কী প্রক্রিয়ায় আবদুল আউয়ালের প্রার্থিতা বাতিল করা হলো, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে পিএসসির ভেতরের নাটকীয় সব ঘটনা বেরিয়ে এসেছে।
পিএসসি বলছে, ‘আউয়ালের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথম হওয়ার মতো নয়।’ কিন্তু কীভাবে তিনি প্রথম হলেন, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি পিএসসি। বরং সব সিদ্ধান্তই প্রথা ভেঙে গোপন রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, বার্ষিক প্রতিবেদনে আউয়ালের নাম আসায় পিএসসির দুজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
এই অবস্থায় প্রার্থী আবদুল আউয়াল হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত তাঁকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নির্দেশ দেন। তবে এই আদেশের ছয় মাস পার হলেও তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
এদিকে বরখাস্ত হওয়া একজন কর্মকর্তাও হাইকোর্টে গিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে প্রতিকার চেয়েছেন। তিনি আদালতকে জানিয়েছেন, কম্পিউটার শাখা থেকে তিনি যে ফলাফল পেয়েছেন, তা-ই হুবহু পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। তাতে দেখা গেছে, আউয়াল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন।
জানতে চাইলে আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য সব পরীক্ষার্থীর মতো আমিও আমার আবেদনপত্রের সব কাগজপত্র এক সেট ফটোকপি করে রেখেছিলাম। আমার লিখিত পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষায় বোর্ড আমাকে প্রায় ৪০ মিনিট রাখেন। বোর্ড সদস্যরা যেসব প্রশ্ন করেছিলেন, আমি তার সবগুলোরই সঠিক উত্তর দেই। কিন্তু ফল প্রকাশের আগে হঠাৎ একদিন আমার কাগজপত্র দেখতে গিয়ে দেখি, আবেদনপত্রের সব জায়গায় আমি আমার ঠিকানা নিজের জেলা কুমিল্লা লিখলেও এক জায়গায় বৃত্ত ভরাটে ভুল করেছি। তাতে জেলার জায়গায় কুমিল্লার এক ঘর ওপরে ছিল বান্দরবান, আমি ভুল করে সে বৃত্তটি পূরণ করেছি। আমি দেরি না করে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে ফোন করি। তাঁরা আমাকে একটি আবেদন করতে বলেন। আমিও ভুল সংশোধনের আবেদন করি। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, আমার রোল নম্বর স্থগিত তালিকায় রাখা হয়েছে।’
আবদুল আউয়াল জানান, এরপর ২০১১ সালের ৫ মে পিএসসি থেকে চিঠি যায়। তাতে তাঁকে নিজ জেলার সপক্ষে সব কাগজপত্র নিয়ে পিএসসিতে যেতে বলা হয়। তিনি ওই বছরের ১৮ মে পিএসসিতে যান। সেদিন বোর্ডে ছিলেন পিএসসির তখনকার সদস্য এমরান কবির ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আ ই ম নেছারউদ্দিন। আউয়াল বলেন, ‘তাঁরা আমার কাছে জানতে চান, কীভাবে এই ভুল হলো। আমি তাঁদের সব কাগজপত্র দেখাই। বলি, ওই দিন আমার বোন মারা গেছে। আমি খুব তাড়াহুড়ো করে ফরম পূরণ করি। তাই এই ভুল হয়েছে। এরপর নেছারউদ্দিন স্যার এমরান কবির স্যারের কানে কানে কিছু বলেন। এর পরই এমরান কবির স্যার আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। বলেন, ...বাচ্চা, তুই কীভাবে চাকরি পাস, আমি দেখে নেব। এরপর আমাকে বলেন, তুই লিখ। তোর হাতের লেখা পরীক্ষা করব। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে তাঁরা আমাকে মানসিক নির্যাতন করেন।’
আবদুল আউয়াল বলেন, ‘এই অবস্থায় আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার চাকরি হবে না। কিন্তু ২০১২ সালে পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন দেখে জানতে পারি, আমি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি এবং পুলিশ ক্যাডার পেয়েছি। তখন আমি একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করি এবং হাইকোর্টে রিট করি। প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল, আদালত আমাকে নিয়োগ দিতে বলেছেন। কিন্তু পিএসসি এখনো তা করেনি।’
২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৯তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এর আড়াই বছর পর ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পিএসসিতে উকিল নোটিশ পাঠান আউয়াল। তাতে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিয়োগ না দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়।
পিএসসির ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। তাতে দেখা যায়, ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় শীর্ষ দশে যাঁরা আছেন, তাঁদের নয়জনই কোনো না কোনো বিষয়ে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একমাত্র আবদুল আউয়ালই পাস কোর্সে পড়েছেন, মাস্টার্স করেছেন। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পাস করেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান। পিএসসির প্রতিবেদনেও প্রথম স্থান অর্জনকারী আবদুল আউয়ালের জেলা লেখা ছিল বান্দরবান, যা সংশোধনের জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন।
পিএসসিতে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেল, আবদুল আউয়ালের নাম বার্ষিক প্রতিবেদনে থাকায় ওই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ইউনিট-১২-এর পরিচালক পিএসসির প্রধান মনোবিজ্ঞানী রওশন আরা জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক অপরাধে জড়িত থাকারও অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে রওশন আরা প্রথম আলোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
২০১১ সালের ৯ জুন পিএসসির একটি সভা এবং ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর পিএসসির ১২তম বিশেষ সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, জেলার তথ্য ভুল থাকায় আবদুল আউয়ালের ফল প্রাথমিকভাবে স্থগিত করা হয়। এর পরই এমরান কবির ও নেছারউদ্দিনের সামনে তাঁকে ডাকা হয়। এই দুজন পিএসসিকে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, ‘তাকে (আউয়াল) তাৎক্ষণিক দুটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেওয়া হয়। তাঁর বাস্তব জ্ঞান এবং ওই দুটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনি যে উত্তর লিখেছেন, তাঁর ব্যাপক বৈসাদৃশ্য রয়েছে। এ ছাড়া সাধারণত একেকজন বিসিএস পরীক্ষার্থী একাধিক বিসিএস পরীক্ষা দেয়। কিন্তু আবদুল আউয়াল এর আগে কোনো বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।’
পিএসসির কার্যবিবরণীতে লেখা আছে, ‘ভুল তথ্য দেওয়ায় এবং তার প্রকৃত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হলো। ভবিষ্যতের যেকোনো সরকারি চাকরির পরীক্ষায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হলো।’
পিএসসির কার্যবিবরণীর এই তথ্য জানিয়ে আউয়ালের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি কি পরীক্ষায় কোনো অসদুপায় অবলম্বন করেছেন? আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। আমি বদরুন্নেসা কলেজ কেন্দ্রে আরও অনেকের সঙ্গেই পরীক্ষা দিয়েছি। তাঁরা ৪০ মিনিট আমার ভাইভা নিয়েছেন। তখন কি তাঁদের সন্দেহ হয়নি? আর সেদিন তাঁরা আমার কোনো পরীক্ষা নেননি। আমাকে বলেছেন, হাতের লেখা পরীক্ষা করবেন। আর দুই বছর আগে আমি যা লিখেছি, সেটা তো এখন হুবহু মনে থাকবে না।’ আউয়ালের প্রশ্ন, ‘পিএসসি আমার প্রার্থিতা বাতিল করেছে, সেটা তো আমাকে জানাবে। কেন জানাল না? পুরো বিষয়টি কেন গোপন করল?’
আপনার কাছে কি কেউ কোনো টাকা-পয়সা চেয়েছিলেন—জানতে চাইলে আউয়াল বলেন, ‘আপনার যা বোঝার বুঝে নেন। তবে আমার টাকা দেওয়ার কোনো সামর্থ্য ছিল না।’
কারও প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করার নিয়ম থাকলেও পিএসসি আউয়ালের ক্ষেত্রে তা করেনি। প্রার্থী আবদুল আউয়াল, এমনকি পিএসসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকেও তা জানানো হয়নি।
কিন্তু ৩১তম বিসিএস পরীক্ষার প্রার্থী কাজী আরিফ বিল্লাহ তাঁর আবেদনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর তারিখ ভুল দেওয়ায় তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। পিএসসির সব ইউনিটের পাশাপাশি সব গণমাধ্যমেও তা পাঠানো হয়। কিন্তু আবদুল আউয়ালের বেলায় পিএসসি সিদ্ধান্ত গোপন রাখে।
পিএসসির সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের কোনো ইউনিট সিদ্ধান্তের বিষয়টি না জানার কারণেই বার্ষিক প্রতিবেদনে আবদুল আউয়ালের নাম চলে আসে। বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের দায়িত্ব থাকে কমিশনের গবেষণা শাখার। তারা ২০১১ সালে প্রতিবেদন তৈরির জন্য ওই বছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শীর্ষ ১০ জনের নাম চেয়ে কম্পিউটার শাখায় একটি চাহিদাপত্র দেয়। কম্পিউটার শাখার কর্মকর্তারাও তাঁদের কাছে সংরক্ষিত ফলাফল পাঠিয়ে দেন এবং তা হুবহু বার্ষিক প্রতিবেদনে ছাপা হয়।
এ নিয়ে আউয়াল রিট করলে পিএসসি প্রতিবেদন প্রকাশের দায়িত্বে থাকা ইউনিট-১২-এর পরিচালক রওশন আরা জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে। রওশন আরা তখন আদালতে যান। আদালত তাঁর বরখাস্তের আদেশ বাতিলের নির্দেশ দেন।
ওই ঘটনায় কম্পিউটার শাখার যে দুই কর্মকর্তা তথ্য সরবরাহ করেছেন, সেই সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ ও আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
আউয়ালের প্রার্থিতা বাতিলে সিদ্ধান্ত গোপন রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নেছারউদ্দিন বলেন, ‘যেখানে জানানো দরকার সেখানে জানানো হয়েছে।’ তবে পিএসসির নিয়ম, প্রার্থিতা বাতিলসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
নেছারউদ্দিন ২০০৮ সাল থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই স্পর্শকাতর পদে এত দীর্ঘদিন কারও থাকার নজির নেই।
আর পিএসসির সাবেক সদস্য এমরান কবির বলেন, ‘আমি আমার একক সিদ্ধান্তে কিছু করিনি। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলাম না। কাজেই বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’