গুলশান কার্যালয়ে খালেদার অবস্থান, বাইরে পুলিশ

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। ভেতরে খালেদা জিয়া। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ‘আটক’। এরপর সেখানে পুলিশের তালা। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বছরপূর্তি ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেই গতকাল শনিবার রাতে বিএনপির দুই কার্যালয় ঘিরে এ-ই ছিল পরিস্থিতি।
রাত আড়াইটায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গুলশানের কার্যালয়ে খালেদা জিয়া অবস্থান করছিলেন, বাইরে পুলিশও ছিল বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, পুলিশের অবস্থানের কারণে খালেদা জিয়া কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। রুহুল কবির রিজভীকে ডিবি আটক করে কোথায় নিয়ে গেছে, তা তাঁরা জানেন না।
কাল ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ মোট ১৬টি স্থানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। আর বিএনপি এখনো সমাবেশের অনুমতি পায়নি। এর পরও দলটি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গতকাল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের ঢাকা মহানগর কমিটির বর্ধিত সভায় ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে রাজধানীর কোথাও নামতে দেওয়া হবে না। আর বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, ওই দিন কর্মসূচি সফল করতে ইতিমধ্যে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ঢাকা মহানগরের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ এই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আর আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, দলটি কাল বেলা আড়াইটায় ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একযোগে আনন্দ শোভাযাত্রা এবং সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে। আর কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঢাকায় ১৬টি স্থানে আনন্দ শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করা হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৬টি দল গঠন করা হয়েছে।
আ.লীগের ১৬ সমাবেশ: ঢাকায় সমাবেশের স্থানগুলো হলো: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক, লালবাগ, শ্যামপুর-জুরাইন রেলগেট, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী মাঠ, সূত্রাপুর, কামরাঙ্গীরচর, সবুজবাগ-খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর টাউন হল, মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর, পূরবী সিনেমা হল, কাফরুল, তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা-রামপুরা পেট্রলপাম্প ও উত্তরা।
এসব স্থানে যেসব কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকবেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ, সাহারা খাতুন, নূহ-উল-আলম লেনিন, সতীশ চন্দ্র রায়, মাহবুব উল আলম হানিফ, দীপু মনি, আবদুর রাজ্জাক, আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ। সংশ্লিষ্ট এলাকার দলীয় সাংসদদের সমাবেশ ও আনন্দ মিছিলের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আট-নয় স্থানে জমায়েতের পরিকল্পনা বিএনপির: বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি সফল করতে কাল দুপুরের আগেই নয়াপল্টনকেন্দ্রিক আশপাশের আট-নয়টি স্থানে জমায়েত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি জমায়েতে সমন্বয়ের জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কর্মসূচি সফল করতে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় করা হচ্ছে। জামায়াত কর্মসূচিতে থাকার কথা দিয়েছে বলে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, সমাবেশের অনুমতি না পেলে রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিতে পারেন, ওই সংস্থাটির কাছে তথ্য রয়েছে। অবশ্য এরই মধ্যে প্রবেশমুখগুলোতে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গতকাল এসব প্রবেশমুখসহ নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশকে তল্লাশি করতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গতকাল কার্যালয়ে দলের নেতা-কর্মীদের প্রবেশে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে জানান, ছাত্রদলের কাউকে গতকাল পুলিশ ওই ভবনে ঢুকতে দেয়নি।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে খালেদা জিয়া সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন। তবে তাঁদের আশঙ্কা, খালেদা জিয়া নয়াপল্টনে যেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। একইভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টনে জমায়েত হতে পুলিশের বাধা এবং যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনদের হামলার শিকার হতে পারেন। এ ধরনের পরিস্থিতি মাথায় রেখেই আট-নয়টি স্থানে জমায়েত হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সমাবেশে জমায়েত হতে বাধা দিলে বা পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে কয়েক দিনের হরতাল দেওয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়।
এখনো অনুমতি পায়নি বিএনপি: বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো অনুমতির অপেক্ষায় আছি। সমাবেশ করা আমাদের চাওয়া নয়, এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হওয়ার যত নিশ্চয়তা দেওয়া দরকার, সব নিশ্চয়তা দিচ্ছি। কিন্তু সরকারি দল ১৬টি জায়গায় গুন্ডামি করে আমাদের সমাবেশ বানচাল করার হুমকি দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, বিএনপি কাল সমাবেশ করবে। সরকার যদি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সমাবেশ করতে না দেয়, তাহলে নেতারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
৫ জানুয়ারি বিএনপি সারা দেশে বিক্ষোভ-সমাবেশ, কালো পতাকা মিছিল এবং ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মতিঝিলের শাপলা চত্বর অথবা নয়াপল্টন—এর যেকোনো একটিতে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে আবেদন করে বিএনপি। গতকাল পর্যন্ত ডিএমপির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল দুপুরে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ও সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে যান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঊধ্বর্তন কোনো কর্মকর্তাকে না পেয়ে ফিরে আসেন তাঁরা। এর আগে বৃহস্পতিবারও এ তিন নেতা ডিএমপিতে গিয়ে কাউকে পাননি বলে জানান।
জয়নুল আবদিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গত ২২ ডিসেম্বর আবেদন করেছেন। বারবার তাঁরা এর অগ্রগতি জানতে গেলেও তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। গতকালও ডিএমপির কার্যালয়ে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার দেখা পাননি।
রাতে বিএনপির দুই কার্যালয়: গতকাল রাতে পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল ধরে নিয়ে যায়। এর আগে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয় ও বাসভবন ঘেরাও করে রাখে বিপুলসংখ্যক পুলিশ।
রিজভীকে আটকের খবরের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আটক নয়, রিজভী দলীয় কার্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁকে অ্যাপোলো হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
তবে ওই কার্যালয়ের একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, রাত ১২টার দিকে ডিবি পুলিশের ১০ থেকে ১৫ জনের একটি দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যায়। তাঁরা রিজভীকে ধরে বাইরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যান। এ সময় ডিবির একজন সদস্য বলেন, রিজভী অসুস্থ। তাই তাঁরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে কোন হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হচ্ছে তা বলেননি।
রিজভীকে নিয়ে যাওয়ার পরও কয়েকজন কর্মচারী দলীয় কার্যালয়ে ছিলেন। পরে ডিবি পুলিশ তাঁদের সবাইকে বের করে দিয়ে কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে চাবি নিয়ে চলে যায় বলে একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
রাত নয়টার পর থেকে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসভবন ও কার্যালয় ঘেরাও করে রাখে বিপুলসংখ্যক পুলিশ। বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শায়েরুল কবীর খান জানান, রাত আটটার পরে খালেদা জিয়া গুলশানের কার্যালয়ে যান। আর রাত নয়টার দিকে পুলিশ তাঁর কার্যালয় ও বাসভবন ঘেরাও করে।
বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের মূল ফটকও গাড়ি দিয়ে আটকে রেখেছে পুলিশ। চেয়ারপারসন তাই কার্যালয় থেকে বের হতে পারছেন না। রুহুল কবির রিজভীকেও কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা তাঁদের জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে গুলশান বিভাগের উপকমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করা হলে কেউ ফোন ধরেননি।