সিলেটের ভারপ্রাপ্ত মেয়রও আরিফুলের 'দোষে' দুষ্ট!

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর মতোই তাঁর ‘দোষে’ দুষ্ট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে ভারপ্রাপ্ত মেয়র রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ তুলে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁকে মেয়র হিসেবে মেনে না নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রেজাউল হাসানের কাছে এ দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়নি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে নাম আসায় গত বুধবার মেয়র আরিফুলকে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দিতে বলা হয় প্যানেল মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েস লোদীকে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মেয়র আরিফুলের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন প্যানেল মেয়র-২ সালেহ আহমদ চৌধুরী। এর আগের দিন কিবরিয়া হত্যা মামলায় আরিফুল হবিগঞ্জের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ: গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সিটি করপোরেশনের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন করে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের একাংশ। সংবাদ সম্মেলনে ১৭ জন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলররা অভিযোগ করেন, যে ‘দোষে’ নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে বরখাস্ত করা হয়েছে, সেই একই ‘দোষে’ দুষ্ট ভারপ্রাপ্ত মেয়র রেজাউলও। তাই তাঁরা তাঁকে এই পদে দেখতে চান না। হত্যা, বিস্ফোরক ও শহীদ মিনার ভাঙচুরের পৃথক তিন মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বরখাস্ত না করে উল্টো ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, গত বছরের ১০ জুন সিটি করপোরেশনের এক সভায় কাউন্সিলরা ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসানের প্যানেল মেয়র-১ থাকার বিরুদ্ধে গোপন ভোটাভুটি করেন। ভোটাভুটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ওই দিন সভায় ২৯ জন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের ২৬ জন অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন। বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলরসহ ৩৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৩৩ জনের স্বাক্ষর-সংবলিত একটি আবেদনপত্রের ফটোকপি সাংবাদিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত বছরের ২ অক্টোবর মেয়র আরিফুল বরাবর পাঠানো হয়েছিল এ আবেদনপত্র। এতে রেজাউলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট গ্রহণের বিষয় উল্লেখ ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ, ফরহাদ চৌধুরী ও মখলিছুর রহমান বক্তব্য দেন। এ সময় জানানো হয়, বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে যাওয়া ও ব্যক্তিগত কাজে সিলেটের বাইরে থাকায় কয়েকজন কাউন্সিলর উপস্থিত হতে পারেননি।
যেসব মামলায় অভিযোগ: ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিন একটি মিছিল থেকে শহীদ মিনার ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে মোস্তাফা মোর্শেদ তাহমিদ (১৮) নামের এক কলেজছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাউজিং এস্টেট এলাকার বাসিন্দা। এ ওয়ার্ডেরই কাউন্সিলর রেজাউলের নেতৃত্বে মিছিলটি হয় এবং এতে তাহমিদ ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে তিনটি মামলা করে। এসব মামলায় রেজাউলকেও আসামি করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুলিশ আদালতে দুই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলা দুটি মহানগর ও জেলা দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। অভিযোগপত্র দাখিলের পর রেজাউল এক মাস কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান।
দায়িত্ব গ্রহণ হয়নি: গতকাল পর্যন্ত রেজাউলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব। রেজাউলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনামুল বলেন, ‘কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী চার্জশিটভুক্ত আসামি। এটি অন্য কাউন্সিলরা আমাদের জানিয়েছেন। বিষয়টি আদালত থেকে সংগ্রহ করে সত্যতা জানতে হবে। কাউন্সিলর কয়েস লোদীকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে মানবেন না বলেও আমাকে জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের অবগত করা হবে।’
ভারপ্রাপ্ত মেয়রের বক্তব্য: মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার বিষয় স্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত মেয়র রেজাউল হাসান দাবি করেন তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক। তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত হলেও বর্তমানে জামিনে আছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই এগুলো বিবেচনা করেই আমাকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র করার নির্দেশনা জারি করেছে।’ কাউন্সিলরদের একাংশের বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আইন মোতাবেক চললে আমার বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ নেই। সম্মানিত কাউন্সিলররা বোধ হয় ব্যক্তিগতভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বিরোধিতা করছেন।’
কিছু তথ্য: টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত কাউন্সিলর রেজাউল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও পরিচিত তিনি। সম্প্রতি মহানগর বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে রেজাউলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, দায়িত্ব গ্রহণ করতে ঢাকা থেকে সিলেট ফিরছেন তিনি।