সরকার কঠোর হলেও অনড় বিএনপি

অবরোধ ঠেকাতে সরকারের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকেরা এখনো বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকার সংলাপ-সমঝোতায় না আসা পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে।
কাল রোববার দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হওয়ার পর সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ আরও কঠোর করতে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার শক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদলের নেতা নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার তার আরও কঠোর মনোভাব সম্পর্কে জানান দিয়েছে বলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন। সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আরও বড় ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন করা হতে পারে, এমনটা ধরে নিয়েই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
অবশ্য অবরোধে সহিংসতা ও পেট্রলবোমা হামলায় সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কিছুটা চাপে পড়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকেও বিদেশি কূটনীতিকেরা বিষয়টি তুলেছেন। এ নিয়ে কূটনীতিকেরা তাঁদের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা এর আগের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ এম মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
পরদিন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক সূত্র জানায়, বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা, দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের পদক্ষেপে কূটনীতিকেরা সন্তুষ্ট নন। কিন্তু ২০ দলের ডাকা হরতাল ও অবরোধে সহিংসতা এবং পেট্রলবোমায় প্রাণহানির দায় বিএনপি এড়াতে পারে না বলে বৈঠকে একাধিক কূটনীতিক বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু সহিংসতায় জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা আছে বলেও মন্তব্য করেছেন। কূটনীতিকেরা অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করার তাগিদ দেন। অবশ্য বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের নেতা রিয়াজ রহমানকে গুলি, অন্য নেতাদের বাসায় ককটেল নিক্ষেপ ও গুলি করার কথা উল্লেখ করে সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন কূটনীতিক বলেছেন, আন্দোলন সহিংস হচ্ছে, এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু তোমরা বলছ, এসব তোমরা করছ না। তাহলে কি জামায়াত-শিবির করছে? কিন্তু তোমরা তো জামায়াতকে ছাড়ছ না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন নেতা বলেন, ‘আমরা বলেছি, জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছে আওয়ামী লীগ। তারা জামায়াতকে নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করেছে, সংসদে বসেছে। এখন বিএনপি ছাড়লে আওয়ামী লীগ যে পাশে নেবে না, এর নিশ্চয়তা কী?’
বিএনপির সূত্র জানায়, আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারকে সংলাপে বসাতে সব ধরনের চেষ্টা চালাবে দলটি। তারই অংশ হিসেবে সরকারকে সংলাপে বসতে আবারও আহ্বান জানিয়ে গতকাল দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, এখন আন্দোলন থেকে পিছু হটলে আবার গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার এবং তাঁদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হবে। এর কিছু আলামত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে বলে বিএনপির একাধিক নেতা দাবি করেন। এ অবস্থায় চলমান অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার আগামী কয়েক দিনে আর কী ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়, তা দেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
সরকারি একাধিক সূত্র জানায়, সহিংস অবরোধে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উদ্বেগে পড়েছে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সারা দেশে, বিশেষ করে সহিংস এলাকাগুলোতে সাত দিনের একটি শক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বলেন, এ সপ্তাহের মধ্যে এই আন্দোলন থেমে যাবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শক্তি প্রয়োগ করে কখনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা যায় না। আমরা যে সংকটের মধ্যে আছি শক্তি প্রয়োগ করে তার সমাধান হবে না।’