সুনাওর আলী

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন

স্কেচ: মো. শামসুজ্জোহা
স্কেচ: মো. শামসুজ্জোহা

একাত্তরের ২৫ মার্চের পর সুনামগঞ্জের (তখন মহকুমা) আইনজীবী সুনাওর আলী শ্যামারচর গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১ মে ভোররাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে নির্বিচার গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রাণরক্ষার তাগিদে তিনি একটি শনের ঘরে আশ্রয় নেন। সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সময় তাঁর নয় বছরের মেয়ে সিতারা এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। তাঁর মেয়েকেও সেনারা গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে জেসমিন সাদিকের ‘আমার বাবা’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘৭১ সালে যখন চারদিকে ভয়াবহ অবস্থা তখন আমরা গ্রামে চলে যাই। নানানানীনহ নানীর বোনের বাড়িতে শ্যামারচরে, ওখান থেকে আমাদের ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথাবার্তা চলছিল। আব্বা ওখানকার লোকদের বলেছিলেন গ্রাম রক্ষার ব্যবস্থা কর, কিশোরগঞ্জের পথে পাক বাহিনী আসতে পারে। কিছু প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
‘কিন্তু ১ মে, ১৯৭১-এর ভোর রাত্রে আব্বার উদ্বেগাকুল কণ্ঠের ফিসফিস শব্দে এবং ধাক্কায় জেগে উঠি। শুধু শুনি ভীত কণ্ঠে বলছেন, ‘ওরা এসে গেছে’। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য ওজু করতে দরজা খুলেই বাইরে খাকি পোশাকে মানুষ দেখে আম্মাকে ডেকে তোলেন, কিন্তু ততক্ষণে বাড়ির লোকজন বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত। আব্বাও আমাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বাঁচার চেষ্টা করেন, কোথায় আমরা আর কোথাই বা বাড়ির লোকজন। অজস্র আগুনের ফুলকির মধ্যে যে যার প্রাণ নিয়ে ভয়াবহ দৌড়। এরই মধ্যে আম্মা আমাকে ধরে নিয়ে একটি শনের ঘরে ঢোকেন। তার হাতে ছয়টির মধ্যে চারটে বাচ্চা। একজন যমদূত বড় গোঁফওয়ালা রাইফেল তাক করে টর্চ জ্বেলে আম্মাকে বাইরে আসতে ইঙ্গিত করে। আমার একমাত্র ছোট ভাই আবেদীনকে বুকে এবং অন্যদের একহাতে আগলে আম্মা বাইরে এসে দাঁড়ান। আর তখনই প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা ছোট বোন শাম্মিকে পেয়ে তাকেও আগলে রাখেন। অতঃপর কি কথা হয়েছিল, কাকুতি মিনতির ভাষা আম্মার কি ছিল কিছু মনে নেই আমার। শুধু মনে আছে রাইফেল তাক করে শুকনো খালের পথে তাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের। তারপর অন্য বাড়িতে কিভাবে পৌঁছাই জানি না। অন্য বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি, ওরা আব্বাকে গুলি করে ফেলে গিয়েছে। আমার ছোট বোন সিতারা সে দৃশ্য দেখে দৌড়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলে হানাদাররা আরেকটা গুলি করে, যা তার কচি ঘাড় দিয়ে বেরিয়ে যায়। বাবা আর মেয়ে দুজন জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে থাকেন বাড়ির পার্শ্বে। কিন্তু শুধু দুজনকে হত্যা নয়, তারা বাড়িতে আগুন দেয়, যার কিছু অংশ আব্বার মাথায় পড়ে চুল পুড়ে যায়। অতঃপর কখন কিভাবে হানাদাররা বাড়ি ত্যাগ করে জানি না।
‘এরপর আমার প্রিয় পিতাকে দেখি, তখন তিনি মানুষের সাহায্যে ডালিম গাছের নিচে, পাশে নয় বৎসরের মেয়ে সিতারা। রক্তে লাল হয়ে আছে তার গেঞ্জি, অর্ধেক চুল পোড়া।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
সুনাওর আলীর জন্ম ১৯২৮ সালের ৯ জানুয়ারি। সুনামগঞ্জের উজানীগাঁও গ্রামে। তিনি সোনাওর আলী পরিচিত ছিলেন। বাবা কনু মিয়া, মা মাস্তোরা বেগম। সুনামগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে। পরে আইন পেশায় যোগ দেন। এ পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক-এর সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ন্যাপের (মোজাফ্ফর) সুনামগঞ্জ শাখার সভাপতি ছিলেন। তাঁরই চেষ্টা জয়কলস উজানীগাঁও জুনিয়র স্কুল হাইস্কুলে উন্নীত হয়। সুনামগঞ্জের খ্যাতনামা আইনজীবী ও সাংবাদিক ছিলেন তিনি। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনকালে তিনি সুনামগঞ্জে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]
ঘোষণা: শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের অনেকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর না থাকায় আমরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাঁদের ওপরের মেইলে কিংবা ০১৭২৭৫২২০১৬ মোবাইল নম্বরে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।