টাকা না পেয়ে হত্যা করল পুলিশ?

পাঁচ দিন মর্গে পড়ে থাকার পর গতকাল ভাষানটেক শিল্পীরটেক মাঠ থেকে উদ্ধার হওয়া গুলিবিদ্ধ যুবকের পরিচয় মিলেছে। তিনি মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা জি এম মো. নাহিদ (২২)। 
তবে নাহিদের স্বজনেরা অভিযোগ করেন, পল্লবী থানার সিভিল টিম তাঁকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় নাহিদের বোন শিলা আক্তার পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
নাহিদের মামা বিএনপির সাবেক মহাসচিব (প্রয়াত) খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। গতকাল রোববার নাহিদের বাবা জি এম সাঈদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তাঁর ছেলে নাহিদের লাশ শনাক্ত করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে গুলিবিদ্ধ লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী নিহত কিশোর তাঁর আত্মীয় বলে দাবি করলেও পরে তিনি আর আসেননি।
এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি রাতে মিরপুর বেড়িবাঁধ থেকে বুকে-পিঠে ১০টি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পরে তাঁর স্বজনেরা লাশটি ছাত্রদেলর নেতা আরিফুল ইসলামের (২৩) বলে দাবি করেন। তাঁরা জানান, ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার সময় সদরঘাটে কর্ণফুলী-৪ লঞ্চ থেকে ডিবি পরিচয়ধারীরা আরিফুলকে ধরে আনে। তবে ডিবি তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয় অস্বীকার করেছে।
মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. নিশারুল আরিফ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি নিহত আরিফুলের স্বজনদের পক্ষ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, পল্লবী অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মুহম্মদ কামাল হোসেন তদন্ত করছেন। তিনি বলেন, নাহিদ শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের সহযোগী। একটি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি নাহিদ গত বছর আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উদ্ধার করার পর ভাষানটেক থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নাসিরউদ্দিনের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা পরিকল্পিতভাবে অজ্ঞাত এই যুবককে গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে গেছে। তাঁর পরনে সাদা জ্যাকেট ও নীল রঙের জিনসের প্যান্ট। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা এই যুবককে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। অবশ্য গতকাল রোববার ভাষানটেক থানা ওই সুরতহাল প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নেয়।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নাহিদের বাবা জি এম সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, নাহিদকে ধরে নেওয়ার পর পুলিশ তাঁকে পল্লবী থানায় ডেকে নিয়ে যায়। থানার এসআই তৌহিদুল ইসলাম ও আরেফিন তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন। চাহিদামতো টাকা না পেয়ে তাঁর ছেলেকে হত্যা করে লাশ ভাষানটেক বালুর মাঠে ফেলে রাখে।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনারের কাছে করা অভিযোগে বলা হয়, ২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের প্রশিকা ভবনের সামনে থেকে এসআই তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে পল্লবী থানার সিভিল টিম নাহিদকে তুলে নিয়ে যায়। পরে সন্ধ্যায় একটি মুঠোফোন নম্বর থেকে নাহিদের বাবা সাঈদকে ফোন করে বলা হয় নাহিদ পল্লবী থানার হেফাজতে আছেন। থানায় এসে নাহিদকে নিয়ে যান। থানায় গেলে পুলিশের তথ্যদাতা তারেক নাহিদের বাবাকে থানার পেছনে ৯ নম্বর রোডে আসতে বলেন। সেখানে গিয়ে জি এম সাঈদ সিভিল টিমের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো চ-১৩-৪৭৬৮) এসআই তৌহিদুল ও আরেফিনকে বসা অবস্থায় দেখতে পান। আর পেছনের আসনে নাহিদকে দেখেন। এ সময় সিভিল টিমের লোকজন বলে পাঁচ লাখ টাকা দিলে আপনার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
পুলিশের কাছে করা অভিযোগে বলা হয়, জি এম সাঈদ ২০ হাজার টাকা নিয়ে গেলে সিভিল টিম নাহিদকে ছেড়ে দিতে রাজি হননি। পরদিন পুলিশের তথ্যদাতা তারেক এক লাখ টাকা নিয়ে নাহিদকে থানায় যেতে বলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি টাকা নিয়ে থানার পাশে যেতে ফোন করা হয়। সাঈদ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেলে এসআই তৌহিদুল ও আরেফিন তা নিতে রাজি হননি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি সিভিল টিমের গাড়িতে নাহিদকে বসা দেখেন। এরপর তাঁকে ওই গাড়িতে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ যে মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ করেছে, সেটি বন্ধ পান। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও আর সন্ধান মেলেনি তাঁর।
নাহিদের বাবা গতকাল মর্গে বলেন, গত শনিবার রাতে পল্লবী থানায় গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মর্গে যেতে বলেন। এরপর মর্গে এসে তিনি নাহিদকে শনাক্ত করেন।
ডিসি নিশারুল আরিফ বলেন, পল্লবী থানায় নাহিদের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা ও দুটি অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। নাহিদের স্বজনদের পুলিশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে যে গাড়িটিতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি পল্লবী থানার সিভিল টিম ব্যবহার করছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাহিদের বাবা বলেন, তাঁর ছেলে নেশাগ্রস্ত। তাই বলে তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে পুলিশ হত্যা করবে কেন? তিনি অভিযুক্ত পুলিশের বিচার দাবি করেন। বাবা বলেন, নাহিদকে দুবাইয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।