অবরোধে কপাল পুড়েছে বিয়েবাড়ির!

‘দাওয়াত খেতে এসে কি বোমায় পুড়ে দুনিয়াছাড়া হতে হবে? তাই ছেলের বৌভাতের অনুষ্ঠান বাতিল করেছি।’ কথাগুলো বলছিলেন তোফাজ্জেল হক। 
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি এই কর্মকর্তার ছেলের বৌভাত ছিল ১৫ জানুয়ারি। প্রায় লাখ টাকার হল ভাড়া নিয়েছিলেন রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পান্থপথের সামারাই কনভেনশন সেন্টার। আনন্দে মেতেছিল তোফাজ্জেল হকের পুরো পরিবার। কিন্তু উচ্ছ্বাসে ভাটা এনে দেয় টানা অবরোধ আর হরতাল।
পেট্রলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণের ভয়ে তাই বৌভাত আয়োজনের সাহস দেখাননি তোফাজ্জেল হক। হলের বুকিং বাতিলই করেন তিনি। মাস খানেক পেরিয়ে গেছে, তবু অনুষ্ঠান আয়োজন করেননি।
তোফাজ্জেল হক একাই নন, বিয়ে-বৌভাতসহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো অনেকেই বাতিল করেছেন। অনুষ্ঠান হলেও পরিসর করছেন ছোট। এতে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর কমিউনিটি সেন্টারগুলোর মালিকেরা। বিয়ের এই ভরামৌসুমে অলস বসে আছেন বাবুর্চিরাও। এর সঙ্গে জড়িত ক্যাটারিং সার্ভিস বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকছে লোকসানে।
ঢাকা শহরের সরকারি-বেসরকারি সব কমিউনিটি সেন্টারে দেখা গেছে একই দৃশ্য। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, শীতকাল সব মিলিয়ে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাসে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের চাপ থাকে। হল ভাড়া বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। তাই এ সময় ব্যবসা করে থাকেন কমিউনিটি সেন্টারের মালিকেরা। এ জন্য আগাম বুকিং নেওয়া শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস থেকে। কিন্তু ৬ জানুয়ারি অবরোধ শুরুর পর থেকে কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় সানাইয়ের সুর আগের মতো বাজছে না। হইহুল্লোড়ও নেই। হাঁড়ি-কুড়ির ঠুংঠাং শব্দ আসে না।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মালিকানায় সরকারি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে ৪৯টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩৬টি। বাকি ১৩টির নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে মূল্য সংযোজন কর দিয়ে থাকে ৭০টি বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টার। তবে প্রায় ৩০০ সরকারি-বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। ব্যস্ত এই সময় সপ্তাহের প্রতিদিনই দুইবেলা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
কিন্তু অবরোধ-হরতালের কারণে কেবল শুক্র ও শনিবার ছাড়া সব অনুষ্ঠানই বাতিল হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান হলেও অতিথি কমিয়ে সেগুলো কাটছাঁট করা হচ্ছে।
আসাদ গেটে নিউ প্রিয়াংকা কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘২২ বছরে ধরে আমরা ব্যবসা করছি। এমন অবস্থা আগে কখনো হয়নি।’
তিনি জানান, এবছরের ৫ জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁদের ৩৫টি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে।
পান্থপথের সামারাই কনভেনশন সেন্টারের ব্যবস্থাপক মো. আবদুল্লাহ দাবি করেন, তাঁদের প্রায় ৯০ ভাগ অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেছে। তাঁর মতে, বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে লোকসানের মাত্রা আরও বেশি হচ্ছে।
আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৫ জন বেতনভুক্ত কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ অন্যান্য খরচ হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। এই লোকসান মেটাব কীভাবে?’
অনুষ্ঠান বাতিলের ধকল সহ্য করতে হচ্ছে ক্যাটারিং সার্ভিসগুলোকেও। ব্যস্ত মৌসুমের বিষয় মাথায় রেখে ক্রেতাদের সঙ্গে আগাম চুক্তি করছে বেশির ভাগ ক্যাটারিং সার্ভিস। মাংস, চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্লেটপ্রতি খাবারে ১০০ টাকা লোকসান হচ্ছে তাদের।
ইব্রাহিম ক্যাটারিং সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে গরু, খাসি, মুরগির সরবরাহ কমে গেছে। চুক্তি আগে থেকে করেছি। এখন তো দাম বাড়ানোর উপায়ও নেই।’
একই সঙ্গে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাশূন্যতায় ভুগছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ওয়েডিং ডায়েরির ক্রিয়েটিভ হেড পলা রহমান জানান, ডিসেম্বর মাসে কোনো কোনো দিন চারটি অনুষ্ঠানের কাজ করেছে তাঁদের প্রতিষ্ঠান। ফেব্রুয়ারির বেশির ভাগ দিনই কাজই মিলছে না।
তিনি বলেন, ‘যাদের বিয়ে কিংবা বৌভাত, সেখানে তো এখন তাঁদের আত্মীয়রা আসতে পারছেন না। পাঁচ শ লোক আসার কথা থাকলেও তা নেমে যাচ্ছে দুই শতে। তাই বড় স্টেজের বদলে এখন ছোট স্টেজ বানাতে হচ্ছে।’
পলা রহমান জানান, মালামাল আনা-নেওয়ার সময় পথে পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশির মুখে তাঁদের পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে রাতের বেলা ট্রাকও চলতে চায় না। তাই বাড়তি ভাড়ার লাভ তো দূরে থাক, লোকসানের হিসাব করা যাচ্ছে না।