তারিখ পড়ে শুনানি হয় না

টানা অবরোধ-হরতালের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩১টি মামলার শুনানি ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার মরিয়ম বেগম হত্যা মামলায় গত দেড় মাসে ২৫টি তারিখ (ধার্য দিন) পড়ে। কিন্তু এক দিনও শুনানি না হওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার মামলাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে ফেরত গেছে।

আইন অনুযায়ী ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসা মামলা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে মামলাটি আগের আদালতে ফেরত যাবে।
হরতালে চট্টগ্রাম আদালতে মামলার শুনানিতে অংশ নেন না আইনজীবীরা। ২৬ বছর আগে চট্টগ্রাম বারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন বিচারপ্রার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি আইয়ুব খান জানান, দিনের পর দিন হরতালে শুনানি না হওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে থাকা কুকুর লেলিয়ে মেধাবী ছাত্র হিমাদ্রী হত্যা মামলাটি ট্রাইব্যুনাল থেকে ফেরত যেতে পারে। এই মামলাটি এ পর্যন্ত ১১৫ কার্যদিবস পার করেছে। এর মধ্যে গত প্রায় দেড় মাসে ২৫ বার মামলার ধার্য দিন থাকলেও শুনানি হয়নি। এ ছাড়া চাঁদপুরের বাক্প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা মামলার পরিণতিও একই রকম হবে।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকা মামলার শুনানি যাতে হরতালে হতে পারে, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইনসচিবকে গতকাল ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি।
৬ জানুয়ারি থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত প্রায় দেড় মাসে অবরোধের পাশাপাশি চট্টগ্রামে হরতাল হয়েছে ২৩ দিন। টানা অবরোধের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিকভাবে এসব হরতাল ডাকা হয়। এ সময় কোনো মামলার শুনানি হয়নি বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
আদালত চালু রাখতে উদ্যোগ: আইনজীবী সূত্র জানিয়েছে, অবরোধ-হরতালের মধ্যে শুনানির তারিখ ধার্য থাকলেও বেশির ভাগ মামলায় সাক্ষী ও জামিনে থাকা আসামিরা হাজির হননি।
চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘হরতালের কারণে মামলাজট বাড়ছে। তাই বারের ২৬ বছরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য তলবি সভা আহ্বান করতে সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে বলেছি।’
১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি সবর্সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়, যে দলেরই হরতাল হোক, আইনজীবীরা আদালতের কার্যক্রমে অংশ নেবেন না।
তবে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি জানায়, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে বারের অনাপত্তি নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে জামিনযোগ্য ধারায় করা মামালায় আসামির পক্ষে জামিন আবেদন করতে পারছেন আইনজীবীরা। গত তিন দিনে ৯৫ জন আসামি জামিনও পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগির মিয়া প্রথম আলোকে জানান, জামিনের আবেদন করতে না পারায় অনেক বন্দী ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তাঁরা খাবার না খেয়ে অনশনে যাওয়ারও হুমকি দিচ্ছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া গত সোমবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি জানান, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গত বুধবার ৫০ জন বন্দী জামিন আবেদনের শুনানির জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছেন।
কারাগার সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন ৬ হাজার ৫২৯ জন। এর মধ্যে হাজতি ৫ হাজার ৫২১ জন। অথচ কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮৫৩ জন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে হরতালে দেশের অন্য এলাকার মতো চট্টগ্রামেও আদালত চালু রাখতে আইনসচিব ও চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে বুধবার আলোচনা হয়েছে। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
তবে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন আইনজীবী ঐক্য পরিষদের নেতা আবদুস সাত্তার বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে ১৭৬ দিন হরতালে আদালতের কার্যক্রম চলেনি। এখন বিএনপি বিরোধী দলে থাকায় কেন বারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হবে। কেউ চাইলেও তা পারবে না।’
চট্টগ্রাম বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফেরদৌস আহমেদ হরতালে শুনানিতে অংশ নেওয়া না-নেওয়ার বিষয়টি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, যেটি আইনজীবী ও মক্কেলদের জন্য কল্যাণকর, সেটির বিষয়ে সবার একমত হওয়া উচিত।
এ বিষয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, হরতালে আদালতের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে কিছু আইনজীবী তলবি সভা আহ্বানের জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেছেন। কিন্তু যাঁরা এই আবেদন করেছিলেন, তাঁরাই আবার বুধবার তা স্থগিত রাখতে আবেদন করেন। তলবি সভায় সবর্সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইনজীবীরা হরতালে আদালতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন কি না। তবে কবে তলবি সভা ডাকা হবে, সে বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
চট্টগ্রাম জেলা সরকারি কৌঁসুলি আবুল হাশেম বলেন, এভাবে দিনের পর দিন হরতাল থাকলে মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। তাই বারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য তলবি সভা আহ্বান করতে বলা হয়েছে।