শান্তি রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে নয়

মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ আছে বলেই ঢাকায় এসেছি। বাংলাদেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়। কারণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি বহুমতভিত্তিক ও সক্রিয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশ সফর শেষে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিনিধিদল এই অবস্থান তুলে ধরেছে।
ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাস গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। উপকমিটির সহসভাপতি ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসে কাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকা ছেড়েছে।
সফরের শেষ দিনে দলটি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে।
প্রতিনিধিদলের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদা বলেন, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকায় আমরা এ সফরে এসেছি। বাংলাদেশকে আমরা শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য উপাদান।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল অবিলম্বে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রস্তাব পুনরায় উল্লেখ করে প্রতিনিধিদল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে অব্যাহতভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে। বিভিন্ন আলোচনায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৌলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিনিময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়নে নাগরিক সমাজের কাজ করার জন্য খসড়া বৈদেশিক সহায়তা আইন যাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ নিশ্চিত করে, সে আশাও করেন। কারণ, ইউরোপীয় অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য এটি জরুরি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শ্রম পরিস্থিতি, নারী ও শিশু অধিকার এবং সংখ্যালঘুসহ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নই এ সফরের লক্ষ্য।
অবস্থান পরিবর্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের: এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের বৈঠকের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল সন্ধ্যায় একটি সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে।
গত বুধবারের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল বিন্দুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।
এ প্রসঙ্গ টেনে ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদা গতকাল সকালে মানবাধিকার কমিশনে আলোচনার সময় বিরক্তি প্রকাশ করেন বলে জানা যায়। প্রেদা খুব স্পষ্ট করেই সেখানে জানান, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে বলেই তাঁদের সফরের আয়োজন করা হয়েছে।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমের প্রাথমিক কয়েকটি প্রতিবেদনের পর মন্ত্রণালয় এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এটি স্পষ্ট করছে যে ১৮ ফেব্রুয়ারির এক ঘণ্টার বৈঠকের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল মানবাধিকার। শ্রম অধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগের বিষয়গুলোতে প্রতিনিধিদল গুরুত্ব দিয়েছে।
স্পিকার ও মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক: ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেন স্পিকার। চলমান সহিংসতার সমালোচনা করে স্পিকার বলেন, সহিংসতা গণতন্ত্র বা রাজনীতির অংশ হতে পারে না। সহিংসতা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধ করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কমিশন সব সময় বিচারবহির্ভূত হত্যার বিপক্ষে। তাই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সরকারের কাছে নিয়মিত সুপারিশ করে আসছে।
প্রতিনিধিদল সংবাদপত্রে প্রকাশিত আটকের তথ্য উল্লেখ করে কমিশনের বক্তব্য জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে সন্দেহজনক যেকোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যখন গণগ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। নিরীহ নাগরিককে কিছুতেই গ্রেপ্তার/হয়রানি করা যাবে না। আটক-বাণিজ্য চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জনমনে আস্থার সংকট তৈরি হবে।’
ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক: গতকাল রাতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুর বাসায় এ বৈঠক হয়।