শ্রদ্ধা শেষে অভিজিতের মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে

অভিজিৎ রায়।ফাইল ছবি
অভিজিৎ রায়।ফাইল ছবি

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের মরদেহ পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দান করা হয়েছে। আজ রোববার বেলা একটার দিকে কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা মরদেহটি গ্রহণ করেন। অভিজিতের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাঁর বাবা অজয় রায়।
এর আগে সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে লাশবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে অভিজিৎ রায়ের মরদেহ প্রথমে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা নিবেদনের কার্যক্রম চলে। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুনুর রশিদ, আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খুশি কবিরের নেতৃত্বে ‘নিজেরা করি’, রোকেয়া কবিরের নেতৃত্বে ‘নারী প্রগতি সংঘ’, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তার বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

অভিজিৎ রায়ের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অজয় রায়সহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান, আইনজীবী সারা হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটা জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটল? এটা আমার নিজের কাছে প্রশ্ন, রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন। একই জায়গায় বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদকে মারা হয়। অভিজিৎ একজন গবেষক, লেখক। সে বই লিখেছে, তার মত প্রকাশ করেছে। এ জন্য কি তার জীবন দিতে হবে? তাকে হত্যা করে হত্যাকারীরা যেন আমাদের সংবিধানকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলল।’ তিনি প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়, সেদিকে নজর রাখার কথা বলেন তিনি।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘অভিজিৎকে হত্যা হলো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত। অভিজিতের মরদেহ পড়ে থাকার সময় তাঁর স্ত্রী সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। অন্যের সাহায্যে আমরা যদি এগিয়ে না আসি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের বিপদেও কেউ এগিয়ে আসবে না।’ অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমার মনে হয়, অভিজিতের হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের মূল টার্গেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিজিতের হত্যাকারীদের না ধরলে প্রধানমন্ত্রীর জীবনও সংকটের মধ্যে। আর আমরা তো কোন ছার!’

অভিজিতের বাবা অজয় রায় তাঁর ছেলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘এই শোকার্ত মুহূর্তে আমার কথা বলার ক্ষমতা নেই। তবে আমার মনে হয়, মৌলবাদী ও ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড সরকারের একটি ব্যর্থতার প্রতীক। কারণ, মৌলবাদীরা যখন তাঁকে হত্যার হুমকি দিচ্ছিল; তখন আমি আইজিপি, ডিআইজি সবাইকে জানিয়েছিলাম। তার পরও এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, তারা কত দরিদ্র, কত ব্যর্থ।’ তিনি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান।

এরপর দুপুর ১২টার দিকে অভিজিতের মরদেহ টিএসসির যেখানে তাঁর ওপর হামলা হয়, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে অভিজিতের মরদেহ নামানো হয়নি। হামলাস্থলের যে অংশ পুলিশ ঘিরে রেখেছে, সেখানে ফু​ল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময় অনেকেই অশ্রুসিক্ত ​হয়ে পড়েন।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে অভিজিৎ রায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বড় মগবাজারের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাসায়। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে মা শেফালী রায় শয্যাশায়ী। ছেলের মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর মরদেহ বেলা একটার দিকে গবেষণার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ (৪৩) গত বৃহস্পতিবার রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর স্ত্রীকেও কুপিয়ে আহত করে তারা। 

আরও পড়ুন: