সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়ে ঢাকায় কর্মরত ১৫টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতেরা প্রধানমন্ত্রীকে যৌথ চিঠি দিয়েছেন। এতে চলমান সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমাতে উত্তেজনাপূর্ণ ভাষা ও সহিংসতা পরিহার করতে বলা হয়েছে।
কূটনীতিকেরা মনে করেন, এ ধরনের পরিবেশ দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নে সহায়ক হবে। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও উগ্রবাদ প্রতিহত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১৬ কূটনীতিক ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে কূটনীতিকেরা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাঁরা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চান। এ লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে তাঁদের আরও কথা বলার সুযোগ করে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চাওয়ার পাশাপাশি তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নেবে।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সই করেন অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অবার্ট, কানাডার হাইকমিশনার পিয়েরে বেনোয়া লাঘামে, জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোসিমা, ডেনমার্কের হ্যানে ফুগ্ল এসকেয়ার, ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু, জার্মানির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ফার্দিনান্দ ভন ভেইয়ে, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত জারবেন ডি জং, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মেরেট লুনডেমো, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ইয়ুন-ইয়াং, স্পেনের রাষ্ট্রদূত লুই তেজাদা চাকোন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ইয়োহান ফ্রিসেল, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ফশ এবং তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হুসেইন মুফতুগলু।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানোর সপ্তাহ খানেক আগে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা, জাপান, নরওয়ে, ফ্রান্স, তুরস্ক ও নরওয়ের কূটনীতিকেরা অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনারের বাসায় বৈঠক করেন। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করার ওপর তাঁরা ওই বৈঠকে জোর দেন।
১৬ কূটনীতিকের এই অনুরোধের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ১ মার্চ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করেন। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে সহিংসতা চালাচ্ছে। যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ার মতো কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ড আইএস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপকর্মের প্রায় কাছাকাছি। কাজেই দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের এসব তৎপরতার নিন্দা জানানো উচিত।
মাহমুদ আলী স্পষ্টভাবেই বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে যারা সন্ত্রাসী কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গত বছরের দুটি প্রস্তাবের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও তাঁরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেননি। বরং মত দিয়েছেন, সমস্যা বাংলাদেশের, সমাধানও করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের মতপার্থক্যের সুযোগ নিয়ে অন্য কোনো গোষ্ঠী যাতে মাথাচাড়া না দেয়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেন বিদেশি কূটনীতিকেরা। তাঁরা সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রশংসা করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ১৬ কূটনীতিককে অবহিত করার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের কাছে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
চলমান সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতার নিন্দা জানিয়ে কূটনীতিকেরা চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাঁরা আশা করছেন, চলমান ঝুঁকিপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক অবস্থা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসবে। সহিংসতা বন্ধ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংঘাত কমিয়ে পারস্পরিক আস্থা স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে, সে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিরাই নেবে। তার পরও সব পক্ষেরই প্রতিপক্ষের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করে, এমন উত্তেজনাকর রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। একই সঙ্গে সহিংস কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহিত করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কূটনীতিকেরা মনে করেন, এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে এমন এক ধরনের পরিবেশ ফিরে আসবে, যেখানে শান্তিপূর্ণ, আইনসম্মত ও গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ তৈরি হবে। প্রকাশ্যে সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের চর্চা নিশ্চিত হবে।
রাষ্ট্রদূতেরা বলছেন, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য এবং জনগণের মাঝে আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে এ ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। যা দীর্ঘ মেয়াদে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অব্যাহত রাখা, উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা রক্ষা ও উগ্রবাদ দমনে সহায়ক হবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানান, চলমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথম ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকেরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে একসঙ্গে চিঠি দিলেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠী ‘টুউইসডে গ্রুপ’। মূলত নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দূরত্ব ঘোচাতে ২০০৫ সালে টিইউসডে গ্রুপের সৃষ্টি। ২০০৭ সালের জানুয়ারির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত এ গোষ্ঠী বেশ তৎপর ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই।