আত্মহত্যা অপরাধ, প্ররোচিত করা আরও বড় অপরাধ

আত্মহত্যার চিত্র
আত্মহত্যার চিত্র

পুলিশের হিসাবে, এ বছরের প্রথম চার মাসে সারা দেশে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিজেকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে তরুণ ও নারীর সংখ্যাই বেশি। যৌতুক, নির্যাতন, বখাটের অত্যাচার, আর্থিক টানাটানি বা পারিবারিক কলহ আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।আইনে আত্মহননের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া আরও বড় অপরাধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা-প্রবণতা ঠেকাতে দরকার মানসিক সহায়তা।মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এমন পাঁচ থেকে ছয়জন রোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তারা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে। তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে সে। মা ছোটবেলায় ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে আর বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। সৎমায়ের কাছে নানা যন্ত্রণায় বেড়ে ওঠা তার। তাই ঘুমের ওষুধ, ব্লেড, দড়ি এমনকি লবণ মিশিয়ে গুঁড়া সাবান খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে মেয়েটি। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সারা দেশে মোট আত্মহত্যা করেছে তিন হাজার ১১৫ জন। এর মধ্যে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে এক হাজার ৯৫৫ জন, বিষপানে এক হাজার ১৬০ জন। গত বছর মোট আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১০৮ জন। ২০১১ সালে আত্মহত্যা করেছে নয় হাজার ৬৪২ জন।

আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীকে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় এক বছর কারাদণ্ড।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস বলেন, বেশির ভাগ সময় মানবিক দৃষ্টি থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তাই এ আইন নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

দেখা গেছে, নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে ১১ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৬ জন নারী। নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন গৃহপরিচারিকার সংখ্যা চারজন। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ১১ জন নারী।

আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, একটি মেয়েকে যখন বখাটেরা উত্ত্যক্ত করে, তখন সে ঠিকমতো আশ্রয় পায় না। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ তাকে দূরে ঠেলে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীর কোনো সাজা হয় না। তাই আক্রান্ত মেয়েটি আরও বেশি নিগৃহীত হয়। সে মনে করে, আত্মহত্যা করা ছাড়া তার কোনো পথ খোলা নেই। তিনি আরও বলেন, খুন, ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, পরকীয়ার আধিক্য—সবই এই বিক্ষুব্ধ সময়েরই প্রতিচ্ছবি।

আইনজীবী ও মনস্তত্ত্ববিদেরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে মানসিক সহায়তা ও চিকিৎসা দরকার।

সংবাদমাধ্যমেরও আত্মহত্যার খবর প্রকাশে দায়িত্বশীল থাকা দরকার। মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল বলেন, আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে নীতিমালা করা জরুরি। এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে, সেটা যেন অন্যকে আত্মহননে উৎসাহিত না করে। মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানমের মতে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বাড়া এবং বিশেষ করে শিশুসন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যমগুলো দায়ী।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে টাঙ্গাইলের সখীপুর ও ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায়। সখীপুরে গত ছয় মাসে ১৪ জন নারী ও নয়জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছে। চলতি বছর ঝিনাইদহ জেলার ছয় উপজেলায়   মোট ১২৬ জন নারী ও ৭৫ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যা ঠেকাতে সচেতনতামূলক কাজ করে ঝিনাইদহের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সোভা। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে আর্থিক ও সামাজিক সমস্যা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ।

জাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, অঞ্চলটিতে বেকারত্ব বেশি। আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক পরিবারেই কলহ দেখা যায়, যার পরিণতি হয় আত্মহত্যা।

বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিন-এর জানুয়ারি ২০১৩-তে প্রকাশিত ‘রিস্ক ফেক্টরস অব সুইসাইড প্যারা রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এর মধ্যে নারী ৬১ ভাগ ও পুরুষ ৩৯ ভাগ।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার কম। শহরাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে প্রতারণার শিকার হয়ে আর গ্রামাঞ্চলে মূল কারণ যৌতুক। এ ছাড়া এখন অল্পবয়স্ক মেয়েরাও উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে।

আত্মহত্যার চিত্র

৩৯% পুরুষ

৬১% নারী

শাস্তি

আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীকে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় এক বছর কারাদণ্ড।

৩,১১৫

জন আত্মহত্যা করেছে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সারা দেশে

১০,১০৮

জন আত্মহত্যা করেছে গত বছর 

৯,৬৪২

জন আত্মহত্যা করেছে ২০১১ সালে 

সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিন