শতরঞ্জিতে স্বপ্নপূরণ

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শাহাবাজ গ্রামে নিজ কারখানায় এক নারীকে শতরঞ্জি তৈরির কৌশল শেখাচ্ছেন হামিদুজ্জামান মুকুল l ছবি: প্রথম আলো
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শাহাবাজ গ্রামে নিজ কারখানায় এক নারীকে শতরঞ্জি তৈরির কৌশল শেখাচ্ছেন হামিদুজ্জামান মুকুল l ছবি: প্রথম আলো

যৌতুকের জন্য স্বামী-শাশুড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিন সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন আসমা খাতুন। বাবা কপিল উদ্দিন ভিক্ষা করতেন। কিছুদিনের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কপিল। সেই শোক সামলাতে না-সামলাতেই মা তানজিনা খাতুনও মারা গেলেন। অথই সাগরে পড়লেন আসমা। সেই আসমাকে বেঁচে থাকার পথ দেখালেন হামিদুজ্জামান মুকুল। তাঁকে শতরঞ্জি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে অভাব জয়ের পথ করে দিলেন।
বাস্তব এই গল্পটি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত শাহাবাজ গ্রামের। শুধু আসমা নন, হামিদুজ্জামানের গড়া শতরঞ্জির কারখানার কল্যাণে শতাধিক নারী বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পেয়েছেন। দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে।
শাহাবাজ গ্রামে হাজার খানেক মানুষের বাস। সাত-আট বছর আগেও এই গ্রামের বাসিন্দাদের অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। যৌতুকের জন্য প্রায়ই ঘটত নারী নির্যাতন ও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। গ্রামের এ চিত্র নাড়া দেয় হামিদুজ্জামানকে। এমন নারীদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতেন তিনি।
হামিদুজ্জামান জানান, যৌতুকের ২৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ২০০৪ সালে গ্রামের ভিক্ষুক মেহেরুন নেছার মেয়ে মরজিনা খাতুনকে নির্যাতন করে ফেরত পাঠান তাঁর স্বামী রবিউল হোসেন। কয়েক দিন পর মরজিনাকে নিয়ে তাঁর স্বামীর বাড়ি পীরগাছা উপজেলার পেটভাতা গ্রামে যান হামিদুজ্জামান। কিন্তু যৌতুকের টাকা নিয়ে না যাওয়ায় মরজিনাকে আবার ফেরত পাঠান রবিউল। হামিদুজ্জামান নিজেদের বাড়ির দুই মণ ধান মরজিনাকে দিয়ে চালের ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দেন। এ নিয়ে ছোট ভাই আলামিন হোসেনের সঙ্গে ঝগড়া হয় তাঁর।
অভিমান করে হামিদুজ্জামান চলে যান রংপুর শহরের নিসবেতগঞ্জে বন্ধু মানিক মিয়ার বাড়িতে। সেখানে চোখে পড়ে একটি শতরঞ্জির কারখানা। জানতে পারেন, এখানে তৈরি শতরঞ্জি দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। লাভও ভালো। কারখানায় কাজ করে স্থানীয় নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। এ সময় নিজের স্বপ্নের কথা উঁকি দেয় হামিদুজ্জামানের মনে। প্রায় ২৫ দিন পর হামিদুজ্জামানকে আনতে বাবা সাইফুল ইসলাম ওই বন্ধুর বাড়িতে যান। হামিদুজ্জামান বাবাকে শতরঞ্জি কারখানাটি দেখিয়ে এনে তাঁর ইচ্ছার কথা জানান। প্রথমে বাবা কারখানা করার টাকা দিতে রাজি হননি। তবে ছেলে জেদ ধরলে আর না করেননি তিনি।
২০০৪ সালের নভেম্বরে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ৬০ হাত একটি টিনের দোচালা ঘর তুলে সাতটি তাঁতকল বসান হামিদুজ্জামান। গ্রামের চারজন নারী ভিক্ষুক ও তিনজন স্বামীহারা নারীকে নিয়ে কারখানা শুরু করলেন তিনি। নিসবেতগঞ্জ থেকে মনজিলা খাতুন নামের একজনকে কারখানায় এনে ১৫ দিন তিনিসহ কারখানার নারীরা কাজ শিখলেন। শুরু করলেন শতরঞ্জি বানানো। ধীরে ধীরে কারখানা বড় হতে থাকে। আরও তাঁতকল বসতে থাকে কারখানায়। বাড়তে থাকে কর্মীর সংখ্যা।
শাহাবাজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর শতাধিক স্বামীহারা ও নির্যাতিত নারীকে খুঁজে এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে কারখানার কাজে লাগান হামিদুজ্জামান। এসব নারী এখন শতরঞ্জিসহ নানা কারুকাজ করা ওয়ালম্যাট, গালিচা, পাপোশ, জায়নামাজ তৈরি করে মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করছেন।
সুখী কয়েকটি মুখ: যৌতুকের কারণে দেড় বছরের মেয়েসহ রোকছেনা বেগমকে তালাক দেওয়া হলে তিনি হরিশ্বার গ্রামে আশ্রয় নেন দিনমজুর বাবার সংসারে। তিনি কাজ নিলেন হামিদুজ্জামানের কারখানায়। এখন তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে, দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারছেন। ৩১ শতক জমি কিনেছেন, আছে একটি গাভি।
শাহাবাজ গ্রামের স্বামীহারা রোকেয়া বেগম হামিদুজ্জামানের কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। খেতে পারছেন তিন বেলা। তাঁর দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে। গ্রামের বানেছা খাতুন বলেন, ‘বাবা, মোক এ কাম শিখি নতুন জীবন দিছে। এলা হামরা আর না খায়া থাকি না।’
নিজপাড়া গ্রামের ফুলতি খাতুন বলেন, ‘এলা মোক বাসাবাড়ির কাজের খোজোত বাইরোত যাবার নাগে না। প্রত্যেক দিন মোর দুই শত টাকা কামাই হয়ছে।’
সামাজিক কর্মকাণ্ড: হামিদুজ্জামান তাঁর কারখানার নারীদের নিয়ে গঠন করেছেন কল্যাণ তহবিলও। কারখানা থেকে যে আয় হয়, তার ১৫ শতাংশ ওই তহবিলে জমা দেওয়া হয়। কারখানার নারীরাও মাসে ৫০ টাকা করে ওই তহবিলে দেন। এই তহবিল পরিচালনা করেন কারখানার কর্মী আসমা ও হাসিনা। তাঁরা জানালেন, অসুস্থ অসচ্ছল ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ওই তহবিল থেকে মাসে পাঁচজনকে ৭০০ করে টাকা দেওয়া হয়। নারীদের সন্তান প্রসবের সময়ও সহায়তা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৩৯টি অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে ওই তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বই-পোশাক কিনে দেওয়া হয়েছে ৭৮ জন অভাবী শিক্ষার্থীকে। হামিদুজ্জামানের স্ত্রী বিজলী বেগম কারখানার কর্মীদের প্রতি শুক্রবার এক ঘণ্টা করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করেন।
কারখানায় কিছুক্ষণ: সম্প্রতি একদিন হামিদুজ্জামানের কারখানায় গিয়ে দেখা গেল শতাধিক নারী শতরঞ্জি তৈরি করছেন। কারখানার পাশে একটি কক্ষে পাঁচজন নারীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। হামিদুজ্জামান জানান, একটি ২৪ বর্গফুটের মাঝারি গালিচা তৈরি করতে সুতা লাগে চার কেজি। প্রতি কেজি সুতা কিনতে হয় দেড় শ টাকা দরে। এ ছাড়া পরিত্যক্ত সুতা কিনে নানা রং মিশিয়ে শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। প্রতি বর্গফুট শতরঞ্জি গালিচা তৈরিতে সব মিলিয়ে খরচ ৫১ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি হয় ৬০ টাকা বর্গফুট হিসাবে।
হামিদুজ্জামান জানালেন, এই গ্রামে এখন মাসে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকার শতরঞ্জি তৈরি হয়। দেশীয় প্রযুক্তিতে বাঁশের তৈরি একধরনের তাঁতকলে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। এই তাঁতকল তৈরিতে খরচ পড়ে পাঁচ হাজার টাকার মতো।
পাঞ্জারভাঙ্গা গ্রামের শতরঞ্জি তৈরির কারিগর সুলতানা খাতুন জানালেন, দিনে ১২ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি তিনি তৈরি করতে পারেন। প্রতি বর্গফুট শতরঞ্জি তৈরির জন্য ১৭ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। সে হিসাবে তাঁদের মাসিক মজুরি গড়ে আসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। অনেকে নিজের বাড়িতেও তাঁত চালিয়ে শতরঞ্জি তৈরি করেন।
স্থানীয় বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হক বলেন, সমাজে হামিদুজ্জামানের মতো মানুষ খুবই দরকার। তিনি দুস্থ নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হামিদুজ্জামান ২০০০ সালে বিএ পাস করেন। পাঁচ বছর বয়সী এক সন্তানের বাবা হামিদুজ্জামান বলেন, ‘যখন শুনি আমার কর্মীদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, ভালো ফল করছে, তখন বুকটা ভরে যায়। স্বপ্ন দেখি, আমার উপজেলায় কোনো নারী দুস্থ থাকবে না।’