হাজারো মানুষ খোলা আকাশের নিচে

ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে ঘর। পরিবারের সদস্যরা তা মেরামত করছেন। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে ঘর। পরিবারের সদস্যরা তা মেরামত করছেন। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল এলাকা থেকে গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের বলিয়াদহ গ্রামের দুলাল মিয়া। স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার। বছর তিনেক আগে জমিজমা বিলীন হয়েছে যমুনা নদীর গর্ভে। গত শনিবার সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর তাণ্ডবে শেষ সম্বল টিনের বসতঘরটিও হারিয়েছেন। সর্বশেষ আশ্রয় হারিয়ে এখন তিনি দিশেহারা। তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করলেও মেলেনি কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য। খাবার নেই, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁইও।
শুধু দুলাল মিয়াই নন, তাঁর মতো অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন শনিবার সন্ধ্যায় কালবৈশাখীতে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার বহু লোক। এমনকি ঝড়ে আহত লোকজন টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে চিনাডুলি ইউনিয়নের পশ্চিম বামনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম পাশে যমুনা নদীর ভাঙনের চিহ্ন, পূর্ব পাশে ঝড়ের তাণ্ডব। এ সময় দেখা যায় মরেদ জামান, হারুন, মালেক মিয়া, জব্বার আলী, বক্কর আলী, জলিল, আলতাফুর রহমান ও গেন্দা মিয়ার বাড়ির টিনের চালা নেই। তাঁদেরসহ প্রায় ২০টি বসতঘরের ধ্বংসস্তূপ পড়ে রয়েছে। একই চিত্র সিংগভাঙা গ্রামের বাট্টু, নবাব মিয়া, দুলাল সরদারের বসতবাড়িরও। তা ছাড়া বামনা বাজার এলাকার তারা মিয়া, আনু, আবুল মিয়া ও সুরুজ মিয়ার দোকানঘর লন্ডভন্ড হয়ে আছে।
একই অবস্থা পাশের বেলগাছা ইউনিয়নেও। ওই ইউনিয়নের মনন্নিয়া গ্রামের ফকির আলী, ময়নাল হক, আবুল হোসেন, কালা চানেরসহ প্রায় অর্ধশত বসতঘর ভেঙে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের শশ্নরিয়া গ্রামের সোহেল, জাফর আলী ও সুজন মিয়ার বসতঘরের অবস্থাও একই। ওই এলাকায় উপড়ে আছে কয়েক শ গাছ। লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি মেরামতের চেষ্টা করছেন।
চিনাডুলি ইউনিয়নের গোলাম হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যমুনা নদীর ভাঙনে সবকিছু আগেই হারিয়ে ফেলেছি। কালবৈশাখীতে তিনটি বসতঘর মুহূর্তেই উড়ে গেছে। একটি টিনও খুঁজে পাইনি। তিন দিন ধরে খেয়ে না-খেয়ে পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য এখনো পাইনি। ঝড়ের কবলে পড়ে আহত হলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলাম না। গতকাল সকালে স্থানীয় চেয়ারম্যান ৫০০ টাকা দিলে তা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি।’
শনিবার সন্ধ্যায় ঝড়ের কবলে পড়ে যমুনা নদীতে একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে চারজন নিখোঁজ হন। এক দিন পর জহুরা বেগমের লাশ উদ্ধার হলেও বাকি তিনজন এখনো নিখোঁজ আছেন। তাঁদের লাশ উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী জানান, ঝড়ের পরদিন সকালেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ টাকা ও ত্রাণসামগ্রীর বরাদ্দ হলেও গত তিন দিনে তা দুর্গত এলাকায় পৌঁছায়নি। বসতবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া মানুষের পাশেও কেউ দাঁড়ায়নি। রোববার সকালে স্থানীয় সাংসদ ফরিদুল হক, জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসূমুর রহমান দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কোনো সাহায্য এখনো পাওয়া যায়নি।
ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঝড়ে ইসলামপুর উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী চিনাডুলি, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা, কুলকান্দি, সাপধরী, পাথর্শী ও সদর ইউনিয়নের দুই হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই সব এলাকার ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি হিসাবে দুই হাজার পরিবারের কথা বললেও স্থানীয়ভাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
ইউএনও বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য চার লাখ টাকা, ১০০ বান্ডিল ঢেউটিন ও ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখনো সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সাহায্য দেওয়া হবে।
চিনাডুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম বলেন, ‘তিন দিন অতিবাহিত হলেও এখনো দুর্গত এলাকায় কোনো সাহায্য দেওয়া হয়নি। শত শত মানুষ না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। তাদের এখনই ত্রাণসামগ্রী প্রয়োজন। শুনেছি, সরকারিভাবে তালিকা করা হচ্ছে। আজ (গতকাল) সকালে ব্যক্তিগত টাকায় কয়েকজনকে সাহায্য করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউএনওর কার্যালয় থেকে আজ ফোন করে ১৭ বান্ডিল ঢেউটিন নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই ইউনিয়নেই প্রায় ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই অল্প কিছু টিন নিয়ে কাকে দেব, বুঝতে পারছি না।’