খালেদার পথসভা ও গাড়িবহরে হামলা

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পথসভা ও গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকেরা এ হামলা চালান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। খালেদা জিয়া তখন মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সরকার-সমর্থকেরা খালেদা জিয়ার গাড়ি, পেছনে থাকা চেয়ারপারসনের অতিরিক্ত গাড়ি (স্পেয়ার কার) ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীদের (সিএসএফ) তিনটি গাড়ি এলোপাতাড়ি ভাঙচুর করেন। এ ছাড়া সেখানে রাখা বেশ কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। হামলায় খালেদার দুজন নিরাপত্তাকর্মী ফজলুল করিম ও ফারুক হোসেন, একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার ও খালেদা জিয়ার একজন গাড়িচালক শাহজাদা শাহেদ এবং সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। খালেদা জিয়ার গাড়ির সামনের অংশে রক্তের দাগ দেখা গেছে। তবে খালেদা জিয়া অক্ষত আছেন।
হামলার প্রতিবাদে আজ বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং কাল বুধবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর বাদে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ এ কর্মসূচি ঘোষণা করে অভিযোগ করেন, খালেদার ওপর হামলা ‘সরকার পরিকল্পিত’।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে ভাঙচুর চালান সরকার-সমর্থকেরা l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে ভাঙচুর চালান সরকার-সমর্থকেরা l ছবি: প্রথম আলো

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যদি কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার সত্যতা আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কানে এসেছে ঘটনাটি অন্য রকম। কারও ওপর হামলা করা হয়নি বরং অন্যদের ওপর বিএনপির লোকজন চড়াও হয়েছিল।’
বিএনপির চেয়ারপারসন গতকাল বিকেলে তৃতীয় দিনের মতো প্রচারণায় বের হন। এর আগে একদিন বাধার মুখে পড়লেও হামলা গতকালই প্রথম। বিকেলে ফার্মগেট পার হয়ে এটিএন নিউজ কার্যালয়-সংলগ্ন গলি দিয়ে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের সামনের রাস্তা হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের দিকে এগোতে থাকে গাড়িবহর। এ সময় যানজটের কারণে বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকে বহরটি। পৌনে ছয়টার দিকে কারওয়ান বাজারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সামনের রাস্তায় গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পূর্বমুখী হয়ে বক্তব্য রাখছিলেন খালেদা জিয়া। এ সময় উল্টোদিক থেকে ‘জয় বাংলা’ ‘রাজাকার’ ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক খালেদা জিয়াকে জুতা ও কালো পতাকা দেখান। বক্তব্যের শেষের দিকে খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে তাঁরা ইট, ডাবের খোসা, ডাস্টবিনের ময়লা ছোড়া শুরু করলে উত্তেজনা তৈরি হয়। কয়েকটি ইট খালেদার গাড়ির ওপর পড়ে। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা ‘ধর ধর’ বলে ঢিল নিক্ষেপকারীদের ধাওয়া করলে সরকারপন্থীরা দৌড়ে চলে যান। তখন খালেদা জিয়া বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ হবে। পরিণাম ভালো হবে না। সরকারের প্রশ্রয়ে গুন্ডামি করছ। তোমাদের দেখে নেব।’
তাঁর এই বক্তব্যের পরপরই সরকারপন্থীরা সংগঠিত হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়িবহরে হামলা চালান। এতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সামনে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় সরকারপন্থী কয়েকজন কর্মী সামনে এগিয়ে গিয়ে বিএনপির একজন কর্মীকে খালেদা জিয়ার গাড়ির পাশেই কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। একজন ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীকে ময়লা-আবর্জনার মধ্যে ঠেসে ধরেন। শুরু হয় হট্টগোল। তখন বক্তব্য বন্ধ করে দিয়ে তড়িঘড়ি করে আবার গাড়িতে ঢুকে পড়েন খালেদা জিয়া। এদিকে মারধরের শিকার ওই বিএনপি কর্মী শটগান হাতে থাকা খালেদার নিরাপত্তাকর্মীদের বলতে থাকেন, ‘গুলি করেন, গুলি করেন’। এসবের মধ্যেই বিএনপির নেতা-কর্মীরাও হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন। নিরাপত্তাকর্মীদের একজনের মাথা ফেটে যায়। সেই রক্ত ফিনকি দিয়ে গাড়ির বনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেখানে গুলির কোনো শব্দ শোনা যায়নি। এ সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে প্রথম আলোর দুটিসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
গতকাল রাতে খালেদা জিয়ার গাড়ি পরীক্ষা করে তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফজলে এলাহী আকবর প্রথম আলোকে ফোনে বলেন, গাড়ির ডান পাশের কাচের ক্ষতি হয়েছে গুলির আঘাতে। গাড়িটি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঁচে গেছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আহত তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দলের (সিএসএফ) এক সদস্য l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আহত তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দলের (সিএসএফ) এক সদস্য l ছবি: প্রথম আলো

এদিকে গতকাল সকালে খালেদার বাসা থেকে পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। হামলার সময়ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের তেমন তৎপরতা ছিল না।
হামলার সময় ঘটনাস্থল থেকে কয়েক গজ দূরে কারওয়ান বাজার মসজিদের সামনে তেজগাঁও থানা-পুলিশের কয়েকজন সদস্য একটি লেগুনা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লোকজন এসে পুলিশকে ‘গ্যাঞ্জাম’ লেগেছে বলে জানালেও পুলিশ সদস্যরা সে-মুখো হননি। খালেদার গাড়িবহরের আশপাশে পাঁচজনের মতো পুলিশ সদস্য ছিলেন। হামলার সময় শুধু একজনকে সরকারদলীয় কর্মীদের ঠেকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। তিনি অবশ্য ব্যর্থ হন।
হামলার পর প্রচারণা বন্ধ করে দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন খালেদা জিয়া ও সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীরা। খালেদার গাড়িবহরকে ধাওয়া দিয়ে রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনসংলগ্ন সড়ক পর্যন্ত চলে যান হামলাকারীরা। সেখান থেকে হামলাকারীরা আবার কারওয়ান বাজারে ফিরে মিছিল করেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর এফডিসি মোড় দিয়ে মগবাজার হয়ে কাকরাইলের দিকে গিয়ে আবার মিন্টো রোডের দিকে চলে আসে। এরপর রূপসী বাংলা হোটেলের আগের মোড় থেকে ঘুরে মালিবাগ হয়ে শাহজাহানপুরের দিকে যায়। সেখান থেকে মির্জা আব্বাসের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালান খালেদা জিয়া। এরপর রামপুরা হয়ে প্রগতি সরণি দিয়ে তিনি গুলশানের বাসায় চলে যান। যাওয়ার পথে তিনি তাবিথের পক্ষে প্রচার চালান।
ঘটনার পর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সামনের রাস্তায় কাচের গুঁড়ো, গাড়ির লাইটের ভাঙা অংশ ইত্যাদি পড়ে থাকতে দেখা যায়। কারওয়ান বাজার এলাকায় লাঠি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মিছিল করতে দেখা যায়। ছাত্রলীগের মিছিল থেকে ‘আমার ভাই মরল কেন খুনি খালেদা জবাব দে’, ‘কারওয়ান বাজারের মাটি ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়ার বাসার সামনে থেকে পুলিশের নিরাপত্তা তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে আইনত তিনি পুলিশ প্রটোকল পান না। তবে যেহেতু তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু ঝুঁকি বিবেচনা করে তাঁর বাসার নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঝুঁকি মনে হলে পুলিশ মোতায়েন করা হয় আবার পরে প্রত্যাহার করা হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তাঁর বাসা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া প্রটোকল পাবেন না। কিন্তু তিনবাবের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নিরাপত্তা জরুরি।
ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়মটা হলো যে বাসায় পুলিশ মোতায়েন থাকবে, সেই বাসাতেই তাদের থাকার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু ফিরোজায় পুলিশের আগের থাকার জায়গায় এখন খালেদার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী সিএসএফের সদস্যরা থাকছেন। বারবার বলার পরও তারা পুলিশের থাকার ব্যবস্থা করেনি। তাই পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হয়।