'ভোট কিল্লা দিতু যাইয়ুঁম? লাপ্পান কী?'

৩০ বছর আগে চট্টগ্রামের লালখান বাজারের মতিঝর্ণা বস্তিতে বসতি গড়েন শাহান আরা। এক কামরার ছাপরাঘরের জন্য তখন মাসে ১২০ টাকা ভাড়া দিতে হতো তাঁকে। হোসেন কলোনির ওই ঘরের ভাড়া এখন ৩ হাজার ৬০০ টাকা। গ্যাস নেই। পাহাড়ের নিচ থেকে বালতিতে ভরে পানি আনতে হয়। বস্তির চারপাশে আবর্জনা। নেই শৌচাগারের ভালো সুবিধা।
এই যখন অবস্থা, ২৮ এপ্রিলের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দেবেন কি না, জানতে চাইতে খেপে উঠলেন লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রামে স্থায়ী হওয়া শাহান আরা। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ভোট কিল্লা দিতু যাইয়ুঁম? লাপ্পান কী?’ (ভোট কেন দিতে যাব? লাভটা কী?)। তাঁর অভিযোগ, কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া তো দূরের কথা, একবার কী এক প্রয়োজনে কাউন্সিলরের দপ্তরে সই আনতে গিয়ে তাঁকে ২০০ টাকা দিতে হয়েছে।
শাহান আরার প্রতিবেশী পারভীনের ক্ষোভ, বর্ষা এলেই প্রশাসনের লোকজন তাঁদের ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাপ দেন। অথচ ঘর ছেড়ে গেলে জিনিসপত্র চুরি হওয়ার আশঙ্কার চেয়ে বড় বিপদ ঘরটাই না হাতছাড়া হয়ে যায়। তাঁর সাফ কথা, নির্বাচন এলেই সবাই খোঁজ নিতে আসে, অন্য সময় কেউ খবরও নেয় না।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহযোগিতা না পাওয়া আর ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে বস্তিবাসীর তেমন আগ্রহ নেই। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরের লালখান বাজার, টাইগারপাস ও পাহাড়তলীর বেশ কয়েকটি বস্তিতে ঘুরে ভোটারদের কাছে নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা এই মনোভাব তুলে ধরেন।
এবার চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯ জন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বলছে, বস্তিবাসী ভোটারের সংখ্যা দুই লাখের বেশি।
নদীভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ’৯০ সালে বরিশালের আমিরুন বেগম চট্টগ্রামে আসেন। আশ্রয় নেন নগরের পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির গোলপাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে কোনো রকম একটি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। গত ২৫ বছরে এই বস্তির চেহারা পাল্টে গেছে। উঠেছে সারি সারি টিনের ঘর। তবে আমিরুন বেগমের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি জানান, ভোট চাইতে একের পর এক প্রার্থী আসছেন। তাঁদের জন্য অনেক কিছু করবেন বলে প্রার্থীরা বলেছেন।
কিন্তু বস্তির উন্নয়নে এর আগে কী কাজ হয়েছে, জানতে চাইলে ষাটোর্ধ্ব আমিরুন বেগম বলেন, ‘প্রার্থীরা তো টাকাপয়সা দেই শুনি। কিন্তু তা আমাদের পেটে আসে না। নেতা-কর্মীরা ভাগাভাগি খেয়ে ফেলে।’
মতিঝর্ণার টাংকির পাহাড়ের বস্তিতে গিয়ে কথা হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আসা মো. চাঁন মিয়ার সঙ্গে। পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ২০ বছর ধরে এখানে আছেন। তাঁর সমস্যাও অন্যদের মতোই। ষাট পেরোনো এই মানুষটির দাবি, তাঁর বসতির জায়গায় ধসের ঝুঁকি কম। তবে বৃষ্টি এলে দুর্ভোগের কমতি হয় না।
বাটালি হিলের পাদদেশে গড়ে ওঠা বস্তিতে ২০১১ সালের ১ জুলাই দেয়ালধসে প্রাণ হারান ১৭ জন। গতকাল দুপুরে সেখানে অটোরিকশাচালক মো. হারুনের সঙ্গে কথা হয়। টিনের চালায় উঠে তিনি ঘর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা গাছটি ছাঁটছিলেন। হারুন জানান, পাহাড়ের নিচে গিয়ে পানি আনতে হয়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা অবধি চোরাই লাইন থেকে বিদ্যুৎ আনেন। বাকি সময় ঘরপ্রতি ১০ টাকার বিনিময়ে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পান। তাঁদের এসব সমস্যা দেখার যেন কেউ নেই।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নগরের বস্তিবাসীদের উন্নয়নে সরকার, ইউকে এইড ও ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় ২০০৭ সাল থেকে ইউপিপিআরপি প্রকল্পের (নগর অংশীদারত্বের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প) বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করে। সিটি করপোরেশনের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অধীনে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৬৩টি পরিবার উপকৃত হয়েছে।
এই প্রকল্পের আর্থসামাজিক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ হানিফ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন বস্তিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের ইউপিপিআরপি প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৫ হাজার ৪১০টি পরিবারের ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭২ জন দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষকে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। ৪০২টি কমিউনিটি উন্নয়ন কমিটির (সিডিসি) মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। আর চট্টগ্রামের সব বস্তিবাসীকে সেবার আওতায় আনতে হলে প্রায় ছয় শটি সিডিসি গঠন করতে হবে।