বিএনপি নির্বাচনী এজেন্ট পাচ্ছে না

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকাভুক্ত আজিমপুরের একটি মেসে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আরিফ হোসেন ও সারোয়ার উল আলম। দুজনই ওই এলাকার ভোটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তাঁরা ওই এলাকার একটি ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু গত বুধবার তাঁরা অপারগতা জানিয়েছেন।
আরিফ বলেন, সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। এক দিনের জন্য টাকা পাবেন বলে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু আজিমপুর এলাকার আওয়ামী লীগের দুই নেতা তাঁদের এজেন্ট না হতে বলেছেন। ওই দুই নেতা বলেন, ‘পড়াশোনা করতেছো করো। অযথা বিপদ ডেকে আনার দরকার নাই। এখন এজেন্ট হলে পরে এই এলাকায় কোনো অঘটন ঘটলে মামলায় তোমার নাম চলে আসবে।’
আরিফ বলেন, ‘অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে ধমক দেননি। বলা যায়, ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। সমস্যা বুঝে আমরা দুজনই এজেন্ট হতে পারব না বলে ছাত্রদলের ভাইদের জানিয়েছি।’
দক্ষিণের চেয়ে উত্তর সিটিতে বিএনপি-সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের জন্য এজেন্ট নিয়োগ আরও কঠিন। গতকাল পর্যন্ত এজেন্টের যেসব তালিকা তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে এসেছে, তাদের একটি অংশ নিজেদের নাম প্রত্যাহার করার কথা জানিয়েছেন। তা ছাড়া নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অনীহার কারণে এখন পর্যন্ত উত্তরের জন্য এজেন্টের তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি তারা। এমনকি টাকার বিনিময়েও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা বেকারদের রাজি করানো যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিল প্রার্থী কফিলউদ্দিন এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের ভয়ভীতি দেখানোর কথা উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, উত্তরা (পশ্চিম) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এজেন্ট না হতে দলের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
ওই এলাকায় বিএনপির নির্বাচন পরিচালনাকারী শফিউল আলম বলেন, ‘পুলিশ এজেন্টদের নাম চায়। তাদের এলাকার ছেলেরা এজেন্ট হতে চাচ্ছেন না। তবে ওসি রফিকুল ইসলাম বলেছেন, কেউ অভিযোগ করলেই তা সঠিক নয়। নির্বাচন-সংক্রান্ত কোনো কাজে পুলিশ যুক্ত নয়। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করছে।
সরকারদলীয় লোকদের হুমকি, সেনাবাহিনী না নামানো, বিএনপি চেয়ারপারসনের ওপর হামলা এবং পুলিশের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর অভিযোগসহ নানা কারণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন ভোটকক্ষে দলীয় এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপি-সমর্থিত দুই মেয়র পদপ্রার্থী। মূলত এজেন্ট হয়ে নির্বাচনের পর সরকারদলীয় লোকদের রোষানলে পড়ার ভয়ে ও পুলিশি হয়রানির আশঙ্কায় স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা এজেন্ট হতে চাচ্ছেন না।
আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। এতে উত্তর সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী হলেন তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণে মির্জা আব্বাস। দুই সিটিতে তাঁদের প্রত্যেককে ভোট কক্ষের জন্য সাড়ে চার হাজার নির্বাচনী এজেন্ট প্রয়োজন হবে। দুই সিটিতে লাগবে প্রায় নয় হাজার। এ ছাড়া ওই দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের সামনে নির্বাচনী অফিস পরিচালনার জন্য আরও প্রায় ১০ হাজার কর্মীর প্রয়োজন হবে।
অবশ্য উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলম ও দক্ষিণের মিহির সারোয়ার মোর্শেদ বলেছেন, ভোটকেন্দ্র সব প্রার্থীর এজেন্টকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তা ছাড়া প্রার্থীরা যাকে এজেন্ট করতে চান, তাদের পরিচয়পত্র দিতে কমিশন কোনো বাধা হবে না। তবে এজেন্ট নিয়োগ করাটা প্রার্থীদের কাজ। এটা করতে না পারার পেছনে কোনো কারণ থাকলে তাঁরা কমিশনে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালনরত বিএনপির নেতারা বলেছেন, এজেন্ট, অফিস পরিচালনা ও ভোটকেন্দ্রের আশপাশে লোক রাখাসহ বিভিন্ন কাজে দুই সিটিতে অন্তত ৬০ হাজার লোক দরকার। অথচ শুধু এজেন্ট ও কেন্দ্রভিত্তিক অফিস পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় ২৫ হাজার লোক নিয়োগ করার মতো নেতা-কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাঁরা তো আসবেই না। মামলা নেই এমন নেতা-কর্মীরাও তাঁদের অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন। অর্থের বিনিময়েও সাধারণ ভোটারদের বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও বেকার যুবকদের আগ্রহী করা যাচ্ছে না। দুটি সিটি করপোরেশনের জন্য করা তালিকার অনেকেই নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ফলে এখন এজেন্ট নিয়োগ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশি হয়রানির ভয়ে এজেন্টের তালিকায় থাকা অনেকেই এলাকা ছাড়া হয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটকেন্দ্র ৮৮৯। আর ভোট কক্ষ চার হাজার ৭৪৬টি। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ভোটকক্ষে একজন করে এজেন্ট দেওয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে প্রার্থী একটি করে অফিস করতে পারেন। যেখান থেকে ভোটারদের ভোটার নম্বর ও কেন্দ্র চিহ্নিত করার ব্যাপারে সহায়তা করা হয়। তা ছাড়া দক্ষিণে এবার প্রায় ৩০০টি স্কুল বা কলেজে ভোটকেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়েছে। বিএনপি প্রতিটি কেন্দ্রের আশপাশে অন্তত ২০০ নেতা-কর্মীকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দক্ষিণে দলটির নির্বাচন সমন্বয়কারী স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিপুলসংখ্যক লোক নিয়োগের ধারে কাছেও নেই নির্বাচন পরিচালনাকারীরা।
ঢাকা দক্ষিণে মির্জা আব্বাসের গণসংযোগ সমন্বয়কারী সাবেক ছাত্রদল নেতা বজলুল করিম আবেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের দিন এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। ভয়ভীতি, মামলা, হামলার আশঙ্কা এর কারণ। তিনি বলেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে নানা কৌশল করছে। তবে যেভাবেই হোক তাঁরা ভোটকেন্দ্র পাহারায় শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত লোক নিয়োগ করতে পারবেন।
মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা এজেন্টের একটি তালিকা তৈরি করেছেন।
ঢাকা উত্তরের কড়াইল বস্তির আমির হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে এজেন্ট হতে এক হাজার টাকা ও তিন বেলা খাবার দেওয়ার কথা বলেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। কিন্তু খালেদা জিয়ার ওপর হামলার পর তিনি এখন আর এজেন্ট হতে চাচ্ছেন না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামরে মারল তাতেই কিছু হয় না, আর আমরা তো কিছুই না।’ এক হাজার টাকার জন্য ভোটের পরে ঝামেলায় পড়তে চান না তিনি।
দক্ষিণ সিটির চেয়ে উত্তরে লোক নিয়োগ করা আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির জন্য। কেননা দক্ষিণে মির্জা আব্বাসের নিজস্ব একটি কর্মী বাহিনী আছে। কিন্তু তাবিথ আউয়ালের রাজনৈতিক পরিচয় না থাকায় তাঁর নিজস্ব কর্মী বাহিনী নেই।
উত্তরে ভোটকেন্দ্র এক হাজার ৯৩ ও ভোট কক্ষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৮৯২। উত্তর সিটি নির্বাচন পরিচালনাকারী বিএনপি নেতা মনিরুল হক চৌধুরী বললেন, সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার সরে আসায় সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতা-কর্মীরা সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন। গ্রেপ্তার ভীতি, হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
উত্তরে বিএনপি-সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেছেন, এজেন্ট নিয়োগসহ অন্যান্য কাজ দ্রুতই সম্পন্ন করা হবে।