চলে গেলেন নভেরা আহমেদ

নভেরা আহমেদ
নভেরা আহমেদ

লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গিয়েছিলেন জীবনের বড় একটা অংশ। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সবার চোখের আড়ালে থেকেই বিদায় নিলেন জীবন থেকেও। নভেরা আহমেদ, বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ, গত মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি রেখে গেছেন তাঁর স্বামী গ্রেগোয়া দ্য ব্রন্সকে। দেশে-বিদেশে আরও রেখে গেছেন তাঁর শিল্পকর্মের অসংখ্য গুণগ্রাহী।
প্যারিসপ্রবাসী চিত্র সমালোচক ও নভেরা আহমেদের শেষ জীবনের ঘনিষ্ঠজন আনা ইসলাম প্যারিস থেকে প্রথম আলোকে জানান, বছর খানেক ধরেই নভেরা আহমেদ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এ ছাড়া আক্রান্ত ছিলেন বয়সজনিত আরও নানা জটিলতায়। থেকে থেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল তাঁকে। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল চিকিৎসা নিয়ে চলে যান প্যারিসের হাসপাতাল থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে, শঁন পামেল নামে গ্রামে তাঁর স্বামীর বাড়িতে। গত সপ্তাহ থেকে তাঁর অবস্থার আবার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি কিছুই খেতে পারছিলেন না। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোমায় চলে যান। মঙ্গলবার প্যারিস সময় ভোর রাত তিনটা থেকে চারটার মধ্যে কোনো এক সময় নভেরা জীবনের সীমারেখা পেরিয়ে যান।
আনা ইসলাম জানিয়েছেন, নভেরার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গত বুধবার তিনি শঁন পামেলের নভেরাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠজনদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ সারা দিন বাড়িতে রাখা হয়। মরদেহ পরে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালের হিমঘরে।
১১ মে ওই গ্রামেরই স্থানীয় কবরস্থানে পরিবারের সদস্যরা নভেরাকে অন্তিমশয্যায় শায়িত করবেন।
নভেরার জীবন ও কর্ম: নভেরার জন্ম ২৯ মার্চ ১৯৩৯ সালে। বাবা সৈয়দ আহমেদ। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদীঘির উত্তর পাড়া। নভেরা কলকাতার লরেটো স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। পরবর্তী শিক্ষার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে লন্ডনে পাঠানো হয়। পরিবারের ইচ্ছা ছিল, তিনি আইনে উচ্চতর শিক্ষা নেবেন। তবে শৈশব থেকেই শিল্পানুরাগী নভেরার ইচ্ছা ছিল ভাস্কর্য করার। তিনি সেখানে সিটি অ্যান্ড গিল্ডস্টোন কার্ভিং ক্লাসে যোগ দেন। পরে ভর্তি হন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে। সেখান থেকে তিনি পাঁচ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা কোর্স করেন। এরপর তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা নেন।
নভেরা আহমেদ দেশে ফেরেন ১৯৫৬ সালে। সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। ভাস্কর হামিদুর রহমানের সঙ্গে নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরে অজ্ঞাত কারণে শহীদ মিনারের নির্মাতা হিসেবে তাঁর নামটি সরকারি কাগজে বাদ পড়ে যায়।
নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে। ‘ইনার গেজ’ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীটি কেবল নভেরারই নয়, গোটা পাকিস্তানেই ছিল কোনো ভাস্করের প্রথম একক প্রদর্শনী। তাতে ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল ৭৫টি। প্রদর্শনীতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, লাহোরের পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের সম্পাদক ও প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, লাহোর আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষ শিল্পী শাকির আলীসহ বহু বিদগ্ধজন উপস্থিত ছিলেন। আধুনিক শিল্পধারায় রচিত নভেরার ওই শিল্পকর্মগুলো বিপুল সমাদর পায়। নভেরা আহমেদ এ দেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। সেই প্রদর্শনীর ৩০টি ভাস্কর্য পরে জাতীয় জাদুঘর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। সেই শিল্পগুলো নিয়ে ১৯৯৮ সালে তারা একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করে। নভেরার সেসব ভাস্কর্যের কয়েকটি এখনো জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে স্থাপিত রয়েছে।
নভেরার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী হয় ১৯৭০ সালে, ব্যাংককে। এতে তিনি ধাতব মাধ্যমে কিছু ভাস্কর্য করেন। তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয় প্যারিসে, ১৯৭৩ সালে রিভগেস গ্যালারিতে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্যারিসে তাঁর পূর্বাপর কাজের এক শ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী হয়।
নভেরা আহমেদ ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। দেশের আধুনিক ভাস্কর্যের অগ্রদূত নভেরা আহমেদ প্রায় ৪৫ বছর ধরে পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে নিভৃতে প্যারিসে বসবাস করছিলেন। চলেও গেলেন নীরবেই।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: ইউএনবি জানায়, নভেরা আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নভেরার মৃত্যু পুরো জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। নভেরার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও।