'ছিটের মানুষের' নতুন জীবনের হাতছানি

অবস্থানগত পরিচয়ে তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। অথচ দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় তাঁদের থাকতে হয়েছে ভারতের ভেতর। একই দশা ছিল ভারতের মানুষগুলোরও, তাঁরা এতকাল ধরে থাকছেন বাংলাদেশের ভেতর। কিন্তু বাস্তবে এঁরা দেশহীন, নাগরিকত্বহীন। এঁদের পরিচয় ‘ছিটের মানুষ’।
আবদ্ধ জীবনযাপনের কষ্ট, যাতায়াত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার কষ্ট, নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতার কষ্ট—সব মিলে হাহাকারের এক জীবন তাঁদের। গতকাল বুধবার ভারতের রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল সর্বসম্মতভাবে পাস হওয়ায় শেষ হতে চলেছে এঁদের দীর্ঘশ্বাসে ভরা জীবনের।
বিলটি পাস হওয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। গতকাল দুপুরে তাঁর দপ্তরে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বাধা কেটে গেছে। এখন বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে।
সীমান্ত বিলটি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের (আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর) বাংলাদেশের এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের (আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর) ভারতে থাকবে। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশির ভাগই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসব ছিটমহলের ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে চারটি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারে ৪৭টি এবং জলপাইগুড়িতে চারটি।
এ ছাড়া অপদখলীয় জমিও হস্তান্তর করা হবে। অপদখলীয় জমি হচ্ছে বাংলাদেশের আইনসম্মত জমি ভারতের দখলে। তেমনি বাংলাদেশের দখলে থাকা ভারতের আইনসম্মত জমি। এখন সীমান্ত বিল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত পাবে এই জমির ২ হাজার ৭৭৭ একর এবং বাংলাদেশ পাবে ২ হাজার ২৬৭ একর। আর ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত হবে দুই খাটা ৫৬ (পশ্চিমবঙ্গ), মুহুরী নদী-বিলোনিয়া (ত্রিপুরা) ও লাঠিটিলা-ডুমাবাড়িতে (আসাম)।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর মাত্র ছয় সপ্তাহে ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফ পাকিস্তান ও ভারতের সীমানা নির্ধারণ করে মানচিত্র এঁকেছিলেন। কোনো ধরনের সুবিবেচনা ছাড়া হুট করে সীমানার মানচিত্র থেকে শুরু হয় এক মানবিক সমস্যার।
দীর্ঘ ৬৮ বছরের এ সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ার শুরুটা হয় ১৯৫৮ সালে। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর পাকিস্তানের ফিরোজ খান নুন প্রথম সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের পাশাপাশি অপদখলীয় জমি বিনিময় ও সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে সীমান্ত সমস্যার সমাধান।
সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে স্থলসীমান্ত চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন কোথায় থাকতে চান, সে ব্যাপারে তাঁদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। চুক্তিটি সইয়ের পরপরই বাংলাদেশের সংসদে তা অনুসমর্থন করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতের পক্ষে তা করা হয়নি। ফলে সমস্যার সমাধানও ঝুলে ছিল।
১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তি অনুযায়ী, বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি।
ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।
দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যৌথ সীমান্ত কার্যদল (জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ-জেবিডব্লিউজি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করে ওই কমিটি। ২০১০ সালের নভেম্বরে দুই পক্ষ দিল্লিতে বৈঠক করে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রসঙ্গত, প্রতিবারই ভারত আলাদাভাবে সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সুরাহার ব্যাপারে অটল থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করা, চুয়াত্তরের চুক্তির অনুসমর্থন, ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর—এই ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সমাধান করা হবে।
পরে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরেও আলাদাভাবে ভারত বিষয়গুলো সুরাহা করতে চায়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ও এ পথেই হাঁটতে চেয়েছে ভারত। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অনমনীয় অবস্থানে ভারত পিছু হটে। ছাপা হওয়া চুক্তিতে হাতে লিখে ঘষামাজা করে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সীমান্ত প্রটোকলটি সই করে দুই দেশ। আর রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল পাসের পর তা আজ লোকসভায় পাস হবে।
তবে গত কয়েক মাসে এ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছিল নানান শঙ্কা। কারণ, চুক্তি থেকে আসামকে বাদ দিয়েই এটি পাস করাতে আগ্রহী ছিল বিজেপি সরকার। কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষে বিশেষ করে কংগ্রেস শাসনাধীন রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এ ক্ষেত্রে ছিলেন সংশোধনের কড়া সমালোচক। কংগ্রেস স্পষ্ট করেই বলেছিল, আসামকে বাদ দিলে চুক্তিটি তারা সমর্থন করবে না। আর এ ধরনের সংবিধান সংশোধনী বিলে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন।
মূলত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে অধিকাংশ সময় আটকে ছিল সীমান্ত সমস্যা। এবার যেমন বিজেপি সংশোধন করে বিল আনলে কংগ্রেস তাতে বাদ সাধে। এর আগে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় বিজেপিসহ অন্য দলগুলো এর বিরোধিতা করেছিল।