সীমান্ত চুক্তি দ্রুতই বাস্তবায়নের চিন্তা

স্থলসীমান্ত চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায় ভারত। রাজ্যসভা ও লোকসভায় সীমান্ত বিল সর্বসম্মতভাবে পাস হওয়ার পর বাংলাদেশকে এ মনোভাবের কথা জানিয়েছে ভারত।
এদিকে চুক্তিটি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিক এবং সরকারি কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, চুক্তিটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতির কাজগুলো আগেই সেরে নেওয়া হয়েছিল। এখন বাকি আইনি কিছু প্রক্রিয়াসহ প্রশাসনিক আদেশের বিষয়গুলো। তাই চুক্তিটি বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
তবে ছিটমহল বিনিময়ের আগে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা জোরদার করতে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার

অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সীমান্ত বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ অনুরোধ জানান। ইতিমধ্যে ছিটমহলগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারও করা হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ছিটমহল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পাটগ্রামের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ভারতীয় ছিটমহল এলাকায় ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সীমান্ত চুক্তি সই করেন। ওই বছরই বাংলাদেশের সংসদ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তা করেনি। ফলে দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা অমীমাংসিত থেকে যায়। পরে বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের (আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর) এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের (আয়তন সাত হাজার ১১০ একর) বিনিময়, অপদখলীয় জমির (এক দেশের দখলে থাকা অন্য দেশের আইনসম্মত জমি) হস্তান্তর ও সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশ সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সই করে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল (সীমান্ত বিল) পাস হয়েছে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে সীমান্ত চুক্তির বিলটি পাস হওয়ায় স্থল সীমান্ত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে এখন আর কোনো বাধা নেই। তবে সংবিধান সংশোধনী বিলে রাজ্য বিধানসভার অনুমোদনের বিষয় নিয়ে কিছুটা দ্বিধা রয়েছে। কারণ, সীমান্ত বিলটি অন্য বিষয়ের মতো সাধারণ কোনো বিষয় নয়। তা ছাড়া এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটে না। তার পরও সংবিধান সংশোধনী বিলে রাজ্য বিধানসভার অনুমোদনের বিধান যেহেতু রয়েছে, তাই সীমান্ত বিলের ব্যাপারে আইনি মতামত নেবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কয়েক দিনের মধ্যে বিষয়টি সুরাহার পর চূড়ান্তভাবে সীমান্ত বিলের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করবে ভারত।
দিল্লিতে বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান হাইকমিশনাররা মনে করেন, বিল পাসের মাধ্যমে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অনেকটা কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
জানতে চাইলে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সংসদের দুই কক্ষে সীমান্ত বিল পাস হওয়ায় চুক্তি বাস্তবায়নের মূল কাজটা হয়ে গেছে। এ ছাড়া ছিটমহলের জনগণনার কাজটিও আগে থেকেই করা আছে। এখন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াগত কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে।
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার ও দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সম্মানিত ফেলো তারিক করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় ও সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আগেই কাজ করা আছে। চুক্তি বাস্তবায়নের ধাপগুলো এগিয়ে রাখা হয়েছে। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, ভারতের সংসদে সীমান্ত বিল পাসের পর ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি হস্তান্তর ও ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে হবে, তা দুই দেশ আলোচনা করে ঠিক করবে। এ ব্যাপারে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে।
তবে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে অন্তত ছয় মাস লাগতে পারে। এর একটি কারণ হচ্ছে, পাস হওয়া বিলটিতে রাজ্য বিধানসভাগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশের অনুমোদন নিতে হবে। দ্বিতীয় কারণ, জুন থেকে আগস্ট—এই সময়টা ভারতের পূর্বাঞ্চলে বর্ষাকাল। তাই এ সময় কাজ শেষ হতে বেগ পেতে হবে। আর ছিটমহল বিনিময়ের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা জোরদার করতে বাংলাদেশকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে সীমান্ত বিল পাসের সম্ভাবনা জোরদারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার কয়েকটি ভারতীয় ছিটমহলে লোকজনকে ভয় দেখানো শুরু হয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা দেউলডাঙা, দাশিয়ার ছড়া (কুড়িগ্রাম), শালবাড়ি, কাজলদিঘিসহ (লালমনিরহাট) বেশ কয়েকটি ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীদের ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে। তাঁদের জমি-বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বলা হচ্ছে। বুধবার রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল পাস হওয়ার পর থেকে সেই হুমকি ও শাসানি আরও বেড়ে যায় বলে অভিযোগ। এসব অভিযোগ পাওয়ার পর থেকেই একাধিক ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ জানান। কোনো কোনো নেতা সরাসরি বাংলাদেশের হাইকমিশনে ফোন করে ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ জানান। বৃহস্পতিবার লোকসভায় বিল নিয়ে বিতর্কের সময় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই একাধিক সদস্য এই ‘দৌরাত্ম্য’ বন্ধে সরকারকে সক্রিয় হতে বলেন।