সাংসদ মতিউর, চালান ছেলে মুহিত উর

সরেজমিন: ময়মনসিংহ—১
সরেজমিন: ময়মনসিংহ—১

সাদাসিধে জীবন যাপন করা মতিউর রহমান এবার সাংসদ হওয়ার পর বদলে গেছেন। ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ মতিউর রহমান সম্পর্কে এমন মন্তব্য করলেন শহরের অনেক বাসিন্দা। দল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিবার ও আত্মীয়করণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, সম্পত্তি দখল—এমন নানা অভিযোগ শোনা গেল সাংসদ, তাঁর ছেলে ও স্বজনদের বিরুদ্ধে। মাদকের বিস্তার, যানজট, নীরব চাঁদাবাজি—এসব সমস্যা ছাপিয়ে শহরবাসীর মুখে তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা।
গত ২৯ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহে অবস্থানকালে স্থানীয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। অনেকে বলেছেন, ময়মনসিংহের রাজনীতিতে মতিউরের অনেক অবদান। ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের কারণেই তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এ বয়সে কালি লেগেছে। আবার অনেকে বলেছেন, বয়োবৃদ্ধ সাংসদ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বড় ছেলে মুহিত উর রহমানই এখন সব করছেন। দলে পদ না থাকলেও তিনি তরুণ নেতা পরিচয়ে শহরে পোস্টার লাগিয়েছেন। ঠিকাদারি ও বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক। তবে সাংসদ ও তাঁর পরিবারের প্রভাবের কারণে কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চাননি।
বক্তব্য জানতে ঢাকায় ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাটে গিয়ে সাংসদ মতিউরকে করা অনেক প্রশ্নেরও আগ বাড়িয়ে জবাব দেন মুহিত। ২০১১ সালে দখল ও নিয়োগ-বাণিজ্য এবং সর্বস্তরে মতিউর রহমানের পারিবারিকীকরণ নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
ময়মনসিংহের সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা ফয়জুর রহমান ফকির বলেন, বর্তমান সরকার প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। কিন্তু সাংসদ মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কর্মকাণ্ডে সব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে এখন সাংসদের পরিবারের দখলবাজি, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্যের কথা। এই পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতায় দলের ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা। মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ চায়।
এ বিষয়ে মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ শহরে বাইরের বিভিন্ন উপজেলার লোক থাকেন। তাঁরাই আমার বিরোধিতা করেন, পরিবারের বদনাম রটান। অনেক কিছুই ধারণা থেকে বলেন। শহরের মানুষ আমার বদনাম করেন না।’
ময়মনসিংহে আলোচনা আছে, আপনিই সাংসদের হয়ে সব করছেন—এ কথায় মুহিত উর রহমান বলেন, ‘আব্বা এখনো বিছানায় পড়ে যাননি। উনি কারও কথা শোনার লোক নন। তবে আব্বাকে আমি সাধ্যমতো সহায়তা করি।’

পারিবারিকীকরণ: সাংসদ মতিউর ২০০৪ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এরপর আর সম্মেলন হয়নি। এক যুগ ধরে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রী নুরুন্নাহার শেফালী তাঁর স্ত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক ফাতেমা তুজ জোহরা ভাগনের স্ত্রী।

সাংসদের ভাই মমতাজউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি জেলা মোটর মালিক সমিতি ও জেলা কমিউনিটি পুলিশেরও সভাপতি। আরেক ভাই আফাজউদ্দিন সরকার সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এবং আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। চাচাতো ভাই গোলাম সারোয়ার জেলা যুবলীগ ও জেলা ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি। জেলা যুবলীগের সহসভাপতি আরেক চাচাতো ভাই আজহারুল ইসলাম। ভাগনে আমিনুল ইসলাম পৌর আওয়ামী লীগের এবং আজহারের মামাতো ভাই ইসহাক আলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

সাংসদের আরেক চাচাতো ভাই শ্রমিক লীগের নেতা শামসুল আলম জেলা টেম্পো মালিক সমিতির সভাপতি। চাচাতো ভাই জেলা যুবলীগের নেতা আবদুল আউয়াল ইজিবাইক ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি। শামসুলের স্ত্রীর বড় ভাই পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হোসাইন জাহাঙ্গীর। জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের মৃত্যুর পর অঘোষিতভাবে ওই দায়িত্বও পালন করা জাহাঙ্গীর জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক।

জেলা আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কয়েক বছর ধরে সম্মেলন না হওয়া প্রসঙ্গে মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্মেলন হয় না ঠিক আছে। তবে সবারই রাজনীতি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কেউ চাইলে আমার সঙ্গে কনটেস্ট করে আসুক।’

ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ: স্থানীয় প্রশাসন ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ময়মনসিংহের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদারির দরপত্রে কারা অংশ নেবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করেন মুহিত উর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, দরপত্রে অংশ নেয় নির্বাচিত কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মুহিতকে কমিশন দিতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে ময়মনসিংহের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ১৫৫ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। এর বেশির ভাগ কাজই ছোট ছোট প্রকল্পে ভাগ করে এক কোটি টাকার মধ্যে। এসব কাজের ৯০ শতাংশই পেয়েছে এমএস এন্টারপ্রাইজ, শিলা কনস্ট্রাকশন, প্রজন্ম এন্টারপ্রাইজ ও বাদশা এন্টারপ্রাইজ। এমএস এন্টারপ্রাইজের মালিক খোন্দকার মাহবুবুল আলম। শীলা কনস্ট্রাকশন মাহবুবুলের স্ত্রীর নামে, প্রজন্ম এন্টারপ্রাইজ তাঁর ভাইয়ের এবং বাদশা এন্টারপ্রাইজ বন্ধুর। একই সময়ে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ৩৫ কোটি টাকার কাজের বেশির ভাগও এই চার প্রতিষ্ঠান পেয়েছে।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, একই প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করছে, এটা তাঁরা বোঝেন। কিন্তু তাঁদের কিছু করার নেই।

সিদ্দিকুর রহমান নামের একজন ঠিকাদার বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে তিনি একবার দরপত্র কিনলেও সমস্যা দেখে জমা দেননি। এরপর ময়মনসিংহ শহরে ঠিকাদারিই ছেড়ে দিয়েছেন।

জানতে চাইলে মুহিত উর রহমান বলেন, ‘বিএনপির আমলে ওই দলের লোকজন টেন্ডারবাজি করে। আওয়ামী লীগের সময় আমাদের দলের লোকজন করে। এতে আমার একেবারে সংশ্লিষ্টতা নেই বললে মিথ্যা বলা হবে।’

বালুমহাল: বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদের পুলিশ লাইন ঘাট, কাচারি ঘাট, বেগুনবাড়ী ঘাট ও থানা ঘাটে বালু তোলা চলছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মামলার কারণে গত চার বছর বালুমহালের ইজারা বন্ধ রয়েছে। তবে এগুলো থেকে বালু তোলা বন্ধ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাচারি ঘাট বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদের চাচাতো ভাই আজহারুল ইসলাম। বাকি তিনটি মুহিতের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে পুলিশ লাইন ঘাটে বালু তোলা ও বিক্রির প্রক্রিয়া দেখাশোনা করেন মাহফুজ, থানা ঘাটে জুলহাস ও মোতালেব এবং বেগুনবাড়ী ঘাটে পার্থ ও সুজন।

নিজে নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ অস্বীকার করে এ বিষয়ে মুহিত বলেন, ‘আমার এক চাচা একটি বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন, অন্যগুলো করে দলীয় লোক। আসলে যখন যে সরকার আসে, সেই দলের লোকজনই খায়। তবে আমার ঘরে টাকা আসে না।’

বালু তোলার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, ঘাট থেকে প্রতি ট্রাক বালু নিতে ২০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি ঘাট থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক বালু তোলা হয়।

সাংসদের দখলে কলেজের অধ্যক্ষের বাড়ি: আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন সাংসদ মতিউর রহমান। অধ্যক্ষের জন্য প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৬৯ সালে বাড়িটিতে ওঠেন তিনি। ২০০২ সালের ৩০ জুন তিনি কলেজ থেকে অবসর নিলেও বাড়িটি এখনো ছাড়েননি। বাড়ি ছাড়ার জন্য চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কয়েক দফা চিঠিও দেয়। শহরের বাগমারায় সাংসদের তিনতলা বাড়ি এবং সদর উপজেলার আকুয়া গ্রামে বাড়ি আছে।

এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালে সাংসদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি কলেজের কাছে বকেয়া পান। এ জন্য জেলা প্রশাসককে বলে বাড়িটিতে থাকছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মতিউর রহমান ২০০৯ সালে কলেজটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার পর তাঁর বকেয়া (প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) উঠিয়ে নেন।

এ ব্যাপারে মতিউর রহমান বলেন, ‘এটা অর্পিত সম্পত্তি, কলেজের নয়। দখলদার হিসেবে আছি।’ মুহিত বলেন, ‘দখলদার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়ার চিন্তাভাবনা আছে।’