সাকা চৌধুরীর অজুহাত বিফলে

মানবতাবিরোধী অপরাধ
মানবতাবিরোধী অপরাধ

একাত্তরে করা ঘৃণ্য অপরাধের সাজা থেকে নিস্তার পেতে শক্ত অজুহাত দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। ৪২ বছর পর দেশের সীমানায় থাকতে সাহস পাননি। দাবি করলেন, তিনি সে সময় ছিলেন এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরে। তাতেও কাজ হলো না। আইনের চোখে ঠিকই ধরা পড়লেন সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। পেলেন সর্বোচ্চ সাজা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সাকা চৌধুরীকে গত মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনের দায়ে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগগুলোকে ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে শুরু থেকেই সাকা চৌধুরী বলতেন, একাত্তরে তিনি চট্টগ্রামে থাকা তো দূরের কথা, এ দেশেই ছিলেন না।
এর আগে দেওয়া দুই ট্রাইব্যুনালের ছয়টি রায় পর্যবেক্ষণ করেও দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটনস্থলে না থাকার দাবি করেন। একমাত্র সাকা চৌধুরী দাবি করতেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান। একাত্তরে আর তো দেশে ফেরেননি, ফিরেছেন সেই ১৯৭৪ সালে।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এটিকেই ‘প্লি অব অ্যালিবাই’ হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। আইনের ভাষায় ‘অ্যালিবাই’ শব্দের অর্থ—অপরাধ সংঘটনের সময়ে ও স্থানে অভিযুক্ত ব্যক্তির সেখানে উপস্থিত না থাকার দাবি, যাতে প্রমাণিত হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।
গত মঙ্গলবার দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, অ্যালিবাই প্রমাণের জন্য সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেন চারজন, যাঁদের একজন সাকা চৌধুরী নিজে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে সাকা চৌধুরী জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা যে ঘৃণ্য অপরাধ ও গণহত্যা করেছে, তা-ও তিনি বলেছেন। কিন্তু স্বাধীনতাপূর্ব আন্দোলনের এই ‘নায়ক’ আকস্মিকভাবে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য একাত্তরের ২৯ মার্চ করাচি চলে যান। ১৯৭৪ সালের ২০ এপ্রিল দেশে ফেরেন। আসামিপক্ষের অন্য তিন সাক্ষী সাকা চৌধুরীর এ বক্তব্য সমর্থন করেন।

ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, জবানবন্দিতে সাকা চৌধুরী বলেছেন, তিনি বাঙালি নন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নন, পছন্দ করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। যেহেতু তিনি গর্বভরে নিজেকে অবাঙালি দাবি করছেন, সেহেতু এটা ধারণা করা যায়, অবাঙালি হিসেবে তিনি নিজের আদিবাড়ি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে যেতেই পারেন। তবে তিনি যে করাচি গেছেন বা ছিলেন—এমন কোনো দালিলিক নথি দাখিল করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকালের পুরোটা সময় যে সাকা চৌধুরী পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন, তা-ও প্রমাণ করতে আসামিপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।

সাকা চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের ‘গুডস হিল’-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপক্ষের দাখিলকৃত নথি বিশ্লেষণ করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ‘বোমার আঘাতে ফজলুল কাদেরের ছেলে আহত: গুলিতে ড্রাইভার নিহত’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বোমার আঘাতে গুরুতর আহত সাকা চৌধুরীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ বিষয়টি আরও শক্তভাবে প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপক্ষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন রেজিস্ট্রার ডা. এ কে এম শফিউল্লাহর সাক্ষ্য নিয়েছে, যিনি কীভাবে আহত সাকা চৌধুরীর চিকিৎসা করেছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন। এ ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন (সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় ভাগ, ১৯৭১) অনুসারে এটা প্রমাণিত হয়, সাকা চৌধুরী বোমার আঘাতে আহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের কমপক্ষে ১৪ জন সাক্ষী সাকা চৌধুরীর ঘটনাস্থলে থাকার প্রত্যক্ষদর্শী। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, খোদ আসামির দাখিল করা যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ বইতে সাকা চৌধুরী ও তাঁর বাবার নাম যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় উল্লেখ আছে। এ ছাড়া আসামির দাখিল করা আমার যুদ্ধ আমার একাত্তর ও বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল বই দুটিতে স্পষ্ট বলা আছে, একাত্তরের জুন মাসে সাকা চৌধুরী বাংলাদেশে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি কেন আসামিপক্ষ এসব বই আমাদের দিয়েছে, কারণ এসব বইয়েই তাঁদের অ্যালিবাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়।’

সাকা চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক যুক্তি উপস্থাপনের সময় বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষের বেশির ভাগ সাক্ষী হচ্ছেন ‘ভিখারি ও বাউণ্ডুলে’, সামাজিক অবস্থানের জন্য তাঁদের বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখা যায় না। বিপরীতে আসামিপক্ষের সাক্ষীরা হচ্ছেন অভিজাত ও সমাজের উঁচু শ্রেণীর ব্যক্তি। তাঁদের বক্তব্য বেশি গ্রহণযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমাদের সমাজে দেখা যায়, উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা গরিব মানুষের চেয়ে ঘৃণ্য অপরাধে বেশি জড়িত থাকে।’

রা য়ে র খ স ড়া ফাঁ স : না গ রি ক অ ভি ম ত