হাজরে আসওয়াদ মাকামে ইব্রাহিমে হজযাত্রীরা

প বি ত্র হ জ
প বি ত্র হ জ

মক্কার জমজম টাওয়ার ও হোটেল হিলটনের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে মসজিদুল হারামের মার্বেল চত্বরে এলাম। মসজিদুল হারামের অনেকগুলো প্রবেশপথ। এক নম্বর প্রবেশপথের নাম বাদশাহ আবদুল আজিজ প্রবেশদ্বার। এই পথে সামনের দিকে এগোচ্ছি। চোখের সীমানায় গিলাফে মোড়ানো কাবাঘর। রেওয়াজ হলো, কাবাঘর দেখার সঙ্গে সঙ্গে যা মনে আসে, তা চাইতে হয়। কারণ, এখানে দোয়া কবুল হয়।
মসজিদের মেঝে ও কার্পেট পার হয়ে মাতাফে নামলাম। কাবাঘরের চারদিকে তাওয়াফের স্থানকে মাতাফ বলে।
কাবাঘরের চারটি কোণের আলাদা নাম আছে। যেমন হাজরে আসওয়াদ, রকনে ইরাকি, রকনে শামি ও রকনে ইয়ামেনি। হাজরে আসওয়াদ বরাবর কোণ থেকে শুরু হয়ে কাবাঘরের পরবর্তী কোণ রকনে ইরাকি, তারপর মিজাবে রহমত, এরপর হাতিম। হাতিম হলো কাবাঘরের উত্তর দিকে মানুষ সমান অর্ধবৃত্তাকার উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি স্থান। তারপর যথাক্রমে রকনে শামি ও রকনে ইয়ামেনি। এটা ঘুরে আবার হাজরে আসওয়াদ বরাবর এলে তাওয়াফের এক চক্কর পূর্ণ হয়। এভাবে একে একে সাত চক্কর দিতে হয়।
হাজরে আসওয়াদ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার উঁচুতে রাখা। প্রতিবার চক্করের সময় এতে চুম্বন করতে হয়।
আমরা হজের ১৪ দিন আগে মক্কায় এসেছি। তবু জনস্রোতের কারণে বেশ কষ্ট হলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতে পেরেছি। হাতিমেও বেশ কয়েকবার নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। হাতিমে নামাজ পড়া কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়ার সমতুল্য। পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ ও দেয়াল স্পর্শ করার সৌভাগ্য আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন।

হাজরে আসওয়াদের আভিধানিক অর্থ কালো পাথর। মুসলমানদের কাছে এটি অতি মূল্যবান ও পবিত্র। হাজরে আসওয়াদ নিয়ে একটি ঘটনা সবার কম-বেশি জানা। তা হলো, কাবা পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন—এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।

আগে এটি ছিল আস্ত একটা পাথর। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরো হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরোগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। ফ্রেম সংস্করণের সময় চুনার ভেতর কয়েকটি টুকরো ঢুকে যায়। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরো দেখা যায়। এগুলোর আকৃতি বিভিন্ন রকম। বড় টুকরোটি খেজুরের সমান।

ফ্রেমে মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়। এর পাশে ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকে সৌদি পুলিশ। তারা খেয়াল রাখে, ফ্রেমে মাথা ঢোকাতে বা চুম্বন করতে কারও যেন কষ্ট না হয়। হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের জন্য নারীরাও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। কাবা শরিফে বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতে গিয়ে দেখা গেল, ফরজ নামাজ চলাকালে হাজরে আসওয়াদে কেউ চুম্বন করতে পারেন না।

অনেক হজযাত্রী মক্কায় এসে মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) নামাজ আদায়ের পাশাপাশি হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম দেখছেন। কাবা শরিফের পাশেই চারদিকে লোহার বেষ্টনীর ভেতর একটি ক্রিস্টালের বাক্সে আছে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান, প্রায় এক হাত। এটিই মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান। এই পাথরে দাঁড়িয়ে তিনি ঠিক কী কাজ করতেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো, কাবা শরিফের দেয়ালের উঁচু অংশ নির্মাণের সময় তিনি এই পাথরে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। পাথরের মাঝখানে একজোড়া পায়ের ছাপ আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মুজেজার কারণে শক্ত পাথরটি ভিজে তাতে তাঁর পায়ের দাগ বসে যায়। চার হাজার বছরের বেশি সময় পরও মাকামে ইব্রাহিমে সেই পায়ের চিহ্ন অপরিবর্তিত রয়েছে।

হজরত উমর (রা.)-এর সময় পাথরটিকে সরিয়ে বর্তমান জায়গায় বসানো হয়। মাকামে ইব্রাহিমের কাছে বা ঘেঁষে অনেক মুসল্লি নামাজ পড়েন, অনবরত চলে তাওয়াফ।

জেদ্দা বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৭৪৩ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে এসেছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এক হাজার ৫৫৩ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬৬ হাজার ১৯০ জন এসেছেন।

প্রতিদিন হাজিদের ছবি, মৃত হাজির নাম, পরিচয় ও তথ্য হালনাগাদ করা হয় http://www.hajj.gov.bd এই ঠিকানায়।