এক সপ্তাহে উদ্ধার ২৮০০

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূল থেকে গতকাল উদ্ধার হওয়া এসব অভিবাসীর বেশির ভাগই রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি। তাদের আশ্রয় জুটেছে স্থানীয় কুয়ালা লাংসা এলাকার একটি অস্থায়ী কেন্দ্রে l ছবি: এএফপি
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূল থেকে গতকাল উদ্ধার হওয়া এসব অভিবাসীর বেশির ভাগই রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি। তাদের আশ্রয় জুটেছে স্থানীয় কুয়ালা লাংসা এলাকার একটি অস্থায়ী কেন্দ্রে l ছবি: এএফপি

এবার ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে কয়েক সপ্তাহ ধরে নৌকায় ভাসতে থাকা ৭৪৭ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করা হলো। গতকাল শুক্রবার উদ্ধার হওয়া ওই অভিবাসীরা বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম। একই দিনে আরেকটি নৌকায় থাকা অভিবাসীদের জোর করে গভীর সাগরে ঠেলে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী।
এ নিয়ে ৮ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে অন্তত ২ হাজার ৮০০ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা উদ্ধার হলেন। তাঁরা পাচারের শিকার হয়ে কিংবা চাকরির আশায় অবৈধ পথে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বলছে, আরও ছয় থেকে আট হাজার অভিবাসী সাগরে নৌকায় ভাসছেন। সেখানে খাবার ও পানির অভাবে অভিবাসী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অবৈধ অভিবাসী বলে নৌকাগুলো তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না। খবর এপি, এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্সের।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সাগরে ভাসতে থাকা অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
৭৪৭ অভিবাসী উদ্ধার: ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ জানায়, আচেহ প্রদেশে সুমাত্রা দ্বীপের পূর্ব উপকূলের লাগসা এলাকা থেকে গতকাল জেলেরা নৌবাহিনীর সহযোগিতায় দুটি নৌকা থেকে ৭৪৭ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে একটি নৌকায় ছিলেন ৭০০ জন। পুলিশ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সানারিয়া জানান, বড় নৌকাটি ডুবতে বসায় আশপাশে থাকা জেলেরা ওই অভিবাসীদের উদ্ধার করে উপকূলে নিয়ে আসেন। নৌবাহিনী এতে সহযোগিতা করে। জেলেদের ছোট ছোট নৌকায় ২০ থেকে ৩০ জনকে তুলে নিয়ে তীরে নেওয়া হয় অভিবাসীদের। তাঁদের আচেহ প্রদেশের কুয়ালা লাংসা এলাকায় রাখা হয়েছে। অভিবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানান, অভিবাসীদের সবাই ক্ষুধার্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁরা পানিশূন্যতায়ও আক্রান্ত। অভিবাসী আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অভিবাসীদের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সানারিয়া জানান, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ নৌযানটি সে দেশের উপকূলে ভিড়তে না দেওয়ায় সেটি ইন্দোনেশিয়ার দিকে চলে আসে।
ওই নৌযান থেকে উদ্ধার হওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম মোহাম্মদ আমিন জানান, তাঁরা প্রায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসছিলেন। একপর্যায়ে নৌযানের চালকেরা তাঁদের ফেলে চলে যায়। মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী তাঁদের ইন্দোনেশিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। তিনি অভিযোগ করেন, নৌযানে বাংলাদেশিরা রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
আচেহ তামিয়াং জেলার পুলিশ প্রধান ডিকি স্যান্ডনি জানান, লাগসা থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরে ছোট একটি নৌকা থেকে ৪৭ জন রোহিঙ্গা অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়। এই অভিবাসীদেরও দুর্বল, ক্ষুধার্ত ও পানিশূন্যতায় আক্রান্ত বলে মনে হয়েছে। তাঁদের কুয়ালা সেরুওয়ে গ্রামে নেওয়া হয়েছে।
সাহায্যের আকুতি: এদিকে থাইল্যান্ডের উপকূলীয় এলাকায় নৌযানে ভাসতে থাকা মোহাম্মদ সলিম নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিনিধির কাছে মুঠোফোনে সাহায্যের আকুতি জানান। মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা একটি সংগঠনের কাছ থেকে রয়টার্সের প্রতিনিধির নম্বর সংগ্রহ করেন তিনি। সলিম জানান, থাই উপকূলে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন তাঁরা। খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেছে। তাঁদের অনেকে মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তিনি জানান, অদূরে মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলার দেখে নৌযানে থাকা বেশ কয়েকজন সাগরে লাফ দেন। উদ্দেশ্য ওই নৌকা ও ট্রলারে ওঠা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা তাঁরা জানেন না।
মালয়েশিয়ার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া: নদীতে ভাসতে থাকা অভিবাসীদের আশ্রয় দিতে জাতিসংঘ মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান জানানোয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশটির মন্ত্রী দাতুক সেরি সাহিদান কাশিম। প্রধানমন্ত্রীর বিভাগের এই মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান না জানিয়ে জাতিসংঘের উচিত অভিবাসীদের কম্বোডিয়া ও ফিলিপাইনে পাঠানো। কারণ, ওই দুটি দেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সনদে স্বাক্ষর করেছে।
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ পথে যাওয়া অন্তত দুই হাজার অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে দেশ দুটি। তাদের পক্ষে আর কোনো অভিবাসীকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পাচারকারীরা অভিবাসীদের অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাঠাতে থাইল্যান্ডকে অন্যতম পথ হিসেবে ব্যবহার করত। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ায় তারা অভিবাসীদের নিয়ে সেখানে ঢুকতে পারছে না। দিনের পর দিন ভাসছে সাগরে।
মিয়ানমারের হুমকি: অভিবাসীদের নিয়ে এই পরিস্থিতিকে আঞ্চলিক সংকট আখ্যা দিয়ে ২৯ মে সংশ্লিষ্ট ১৫টি দেশকে নিয়ে সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছে থাইল্যান্ড। তবে মিয়ানমার ওই সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। দেশটি বর্তমান সংকটকে সম্মিলিতভাবে সমাধানের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে বলে দাবি তুলেছে।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের পরিচালক জ এইচটে বলেন, থাইল্যান্ড যদি শুধু নিজেদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে ওই সম্মেলনের ডাক দিয়ে থাকে, তাহলে মিয়ানমার ওই সম্মেলনে যোগ না-ও দিতে পারে।