হাওরে মায়ের হাসি

সন্তানসম্ভবা এক মাকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন একজন স্বাস্থ্য কর্মী। ছবি: সংগৃহীত
সন্তানসম্ভবা এক মাকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন একজন স্বাস্থ্য কর্মী। ছবি: সংগৃহীত

দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে ঘেরা জেলা হবিগঞ্জ। জেলার প্রায় ৬৫ শতাংশই হাওর অঞ্চল। হাওরগুলো বছরের ৭ মাসই থাকে পানির নিচে। তখন গ্রামগুলো হয়ে যায় দ্বীপের মতো। নৌকাই চলাচলের একমাত্র বাহন। শুকনার দিনে পানি নেমে যায়, থাকে বিস্তীর্ণ ধানখেত আর শুধু বালুচর। রাস্তাঘাটহীন সেসব প্রান্তর পাড়ি দিতে হয় পায়ে হেঁটে অথবা লক্করঝক্কর জিপে চড়ে। এলাকাবাসীর ভাষায় চাঁদের গাড়ি।
হবিগঞ্জে মোট উপজেলা ৮ টি। হবিগঞ্জ সদর, লাখাই, মাধবপুর, চুনারুঘাট, বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ। এর মধ্যে লাখাই, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ প্রায় পুরোটাই হাওর।
হবিগঞ্জ সদর থেকে দীর্ঘ সরু আঁকাবাঁকা পিচের রাস্তা এসে থেমেছে বানিয়াচং উপজেলার শেষ প্রান্ত মারকুলি বাজারে। মারকুলি বাজার অনেকগুলো এলাকার সংযোগস্থল।
বাজার থেকে পুকুরের পাশ ঘেঁষে ইউনিয়ন পরিষদের তৈরি করা মাটির রাস্তা পেরিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পৌঁছে প্যারামেডিক নাসরিনকে দেখা গেল সেবা নিতে আসা নারীদের কথা শুনে তাদের ওষুধ ও বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। নাসরিন জানান, প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ জন নারী শিশু বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁদের কাছে আসেন। এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পেছনেই কুশিয়ারা নদী, নদীর অন্য পাড়ে সুনামগঞ্জ। জানা গেল, সুনামগঞ্জ থেকেও অনেকে এখানে সেবা নিতে আসেন। এ ছাড়া প্যারামেডিকেরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্যাটেলাইট ক্লিনিকও পরিচালনা করেন। স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আসা কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা এক বাক্যে বললেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি হওয়ায় তাঁরা খুবই খুশি।

স্থানীয় বাজারেই দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের অফিস। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনজু কুমার দাশ। তিনি একটু ব্যতিক্রমী মানুষ এই অর্থে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও গ্রামে বসতি গড়েছেন। রাজধানীতে পড়াশোনা করে মানুষ সাধারণত গ্রামে থাকতে চান না। ইনি আছেন। মনজু কুমার দাস ২০১১ সালের ১২ই জুন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
দৌলতপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রসঙ্গে মনজু কুমার দাশ বলছিলেন, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায়, অবহেলা ও অযত্নে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। সেখানে যাওয়ার রাস্তাও ছিল না। অবকাঠামোর মধ্যে দুটি শেড ছিল, কিন্তু তাতে শুধুমাত্র এঙ্গেলগুলো ছিল ওপরে টিন ছিল না, কোনো ধরনের বাউন্ডারিও ছিল না। গ্রামবাসী ওখানে যেতো না, সরকারি একজন স্যাকমো (সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার) নিয়োজিত থাকলেও ওখানে যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, সে বিষয়ে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। মামণি (মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসআইডি সহায়তা পরিচালিত) আসার পরে, তাঁর মতে, একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, যা একেবারেই অবিশ্বাস্য।
দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরও বলেন, বর্তমানে এলাকার মানুষ সেখানে স্বাস্থ্য সেবা নিতে যায়, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের খুবই উপকার হচ্ছে। তিনি জানান, মামণির সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের সম্পর্ক খুবই ভালো। মামণির সব ধরনের কার্যক্রমেই সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান, সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ খবর করেন, রেজিস্ট্রার খাতা দেখেন। তিনি বলেন, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন, তারা বোঝেন যে ক্লিনিকে গেলে পরামর্শ ও ওষুধ পাওয়া যাবে।
মামনি প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী সুফিয়া খাতুন বলেন জানান, মামণি যখন বানিয়াচং উপজেলায় কাজ শুরু করে তখন এলাকাবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছিল কম। বিশেষ করে মা ও নবজাতকের ব্যাপারে আলাদা কোনো যত্ন নেওয়ার কথা কেউ ভাবতেন না, বেশির ভাগ প্রসবই হতো বাড়িতে, অদক্ষ প্রশিক্ষণবিহীন দাইদের হাতে। ধর্মীয় গোঁড়ামিও ছিল। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের হারও ছিল কম। তিনি আরও বলেন, মামণির কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মায়েরা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসছেন।
কথা হলো দৌলতপুরের নোয়াগাঁও গ্রামের রূপজানের সঙ্গে। বয়স আনুমানিক ৪৫। তিনি বিধবা। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা তাঁর নেই। জানালেন, গত ১৫ / ২০ বছর ধরে তিনি ধাত্রী হিসেবে কাজ করেন। প্রথমে চাচি শাশুড়ির কাছ থেকে শিখেছেন এবং কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই এত দিন কাজ করেছেন। রূপজান জানান, মামণির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তিনি। প্রশিক্ষণের পরে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে কি পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক কিছু জেনেছি এবং শিখেছি। তাঁর ভাষায়, ‘আগে তো উপ্তা (উল্টা) বাচ্চা দেখলেও অনেক সময় ডেলিভারি করছি। এখন এ রকম দেখলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। ঝুঁকি থাকলে নিজে চেষ্টা করি না।’
দৌলতপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কথা হলো ওই এলাকার এক সমাজকর্মী তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন পাশের গ্রামেরই বাসিন্দা সন্তানসম্ভবা সেলিনা বেগমের কথা। স্বামী বিদেশে থাকেন। গর্ভধারণের পর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাননি বা ডাক্তারও দেখাননি, একবারও চেক-আপ করাননি সেলিনা। এ অবস্থায় গর্ভধারণের ৮ মাসের সময় হঠাৎ করে পানি ভাঙতে শুরু করায় স্বজনেরা সেলিনাকে দৌলতপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। প্যারামেডিক নাসরিন আর সোনিয়া তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন। তাঁদের মতে, বাচ্চার হার্টবিট ভালো, মায়েরও ইউটেরাসও সামান্য খুলতে শুরু করেছে। দুজন সাহস করে ভেবেছিলেন সেখানেই হয়তো প্রসব করানো যাবে। কিন্তু উপজেলা সমন্বয়কারী সুফিয়া বেগম ঝুঁকি নিতে সাহস পেলেন না। তিনি রোগীকে দ্রুত জেলা সদরে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে (একটি টেম্পুকে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়) চড়ে সেলিনা ও তার আত্মীয়-স্বজন যান হবিগঞ্জ সদরের মাতৃমঙ্গলে। সন্ধ্যার পর মাতৃমঙ্গলে পৌঁছানোর পর তাকে আলট্রাসনোগ্রাফিসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অবস্থা জটিল হওয়ার কারণে সেলিনাকে পরদিনই পাঠানো হয় সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ওখানে অপারেশনের মাধ্যমে সেলিনা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সময়মতো হাসপাতালে যাওয়ার কারণে মা ও শিশু দুজনই সুস্থ থাকেন।


ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স

ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স একটা ইঞ্জিনচালিত মাঝারি সাইজের নৌকা। যার ভেতরে একটি বিছানা, বেসিনসহ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দূরের গ্রামগুলোতে বিশেষ করে কামালপুর, মাহতাবপুর, রাহেলা, ছলোরি ও গর্দাইল এলাকায় স্যাটেলাইট ক্লিনিক করতে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হয়। একজন প্যারামেডিক প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এই ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে যান ও চিকিৎসা সেবা দেন। ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স-এর কারণে স্যাটেলাইটগুলোও ঠিকমতো হচ্ছে বলে জানান অনেকে। আগে যারা স্যাটেলাইট করতে দূরের গ্রামগুলিতে যেতেন তাঁদের ফিরে আসার বাহন ছিল না। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেলেও সঙ্গে নৌকা থাকায় ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ রোগী হাসপাতালে পাঠানোর সময়, দূরের রোগীদের হাসপাতালে পরিবহনের ক্ষেত্রে এই ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হয়।

স্থানীয় মানুষজনের ভাষ্য, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ ইউনিয়ন থেকে হবিগঞ্জ জেলা সদরে যেতে লাগে কয়েক ঘণ্টা। উপজেলা সদরে যেতে লাগে তারও বেশি। তাই অসুস্থ নারী বা শিশুরা একসময় অনেক ঝুঁকিতে ছিলেন। কিন্তু দৌলতপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মা ও শিশুদের সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু এ ইউনিয়নই নয়, আশপাশের এলাকার মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সেবায় নতুন দিনের সূচনা করেছে। নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছে ‘হাওরে মায়ের হাসি’র কেন্দ্র হিসেবে।

মামণি দায়িত্ব নেওয়ার আগে দৌলতপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
মামণি দায়িত্ব নেওয়ার আগে দৌলতপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত