হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য

মানব পাচার
মানব পাচার

বঙ্গোপসাগর হয়ে সংঘবদ্ধ চক্রের মানব পাচারের কারবার চলছে অন্তত ১০ বছর ধরে। সাত বছরের মাথায় এটি দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার ‘বাণিজ্যে’। আর ২০১২ সাল থেকে চক্রগুলো এটিকে ‘মুক্তিপণ বাণিজ্যে’ পরিণত করে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ফর্টিফাই রাইটসের তথ্যমতে, গত তিন বছরে চার দেশীয় (বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া) চক্রগুলোর মধ্যে লেনদেন হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আর, অপর এক হিসাবে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে কেবল বাংলাদেশেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালে চার দেশীয় চক্র–গুলো বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক বিস্তারের পর সাগরপথে মানব পাচার ব্যাপক আকার ধারণ করে। চক্রগুলো টাকার জন্য মানুষকে বন্দী, নির্যাতন ও হত্যা করেছে। জঙ্গলে গণকবর দিয়েছে। এ বাণিজ্যের প্রধান ঘাঁটি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গল। কাঁচা টাকার লোভে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে এ কাজে যুক্ত হয়েছেন থাইল্যান্ডের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, সমুদ্রগামী জাহাজের মালিক থেকে গ্রামের রাবারবাগানের শ্রমিকও।
এ প্রতিবেদক থাইল্যান্ডের মালয়েশীয় সীমান্তসংলগ্ন ওই এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পেয়েছেন, এখানকার জঙ্গলে মানব পাচারের বিষয়টি সীমান্ত এলাকার সব মহলই জানত। এর মাধ্যমে কয়েক স্তরের মানুষ যেমন অল্প দিনে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে, আবার গ্রামের রাবার-শ্রমিকেরা ক্যাম্প পাহারা, খাবার সরবরাহসহ ছোটখাটো সহযোগিতা দিয়ে সহজ আয়-রোজগারে জড়িয়েছেন।
এ কারণে গত কয়েক বছর রাবারবাগানে শ্রমিক-সংকট হয় বলে জানিয়েছেন সংখলা প্রদেশের পেদাং বেসার এলাকার মুসলিম কমিউনিটির একজন পঞ্চায়েত নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তির ধারণা, পরিস্থিতি শান্ত হলে এসব চক্র আবার সক্রিয় হবে। রোহিঙ্গা দোভাষীর সহায়তায় তিনি বলেন, ‘এরা মাফিয়া। তাদের হাত অনেক লম্বা। যে পুলিশ এখন এদের ধরছে, কদিন আগে তারাই ছিল এদের দোসর। কদিন পর তারা যে আবার এক হয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?’
রোহিঙ্গা ওই দোভাষী থাই নাগরিকত্ব নিয়ে এই এলাকায় বাস করছেন ১৭ বছর ধরে। তিনি এখানকার পাচারকারী চক্র ও দালালদের অনেককে চেনেন বা তাদের সম্পর্কে জানেন। তিনি বললেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে এ এলাকায় কে পাচারকারীদের দালাল বা সহযোগী; আর কে নয়, তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে স্থানীয় পুলিশও পাচারে জড়িয়ে যায়। বিভিন্ন সময় পাচারের শিকার অনেক মানুষ পুলিশের হাতে আটক হতো। কখনো কখনো জঙ্গল থেকে পালিয়ে দু-একজন পুলিশের কাছে গিয়ে উঠত। আবার, কোনো চক্র ঠিকভাবে মাসোহারা না দিলে তার পাচার করা লোকজন ধরে আনত পুলিশ। পরে এসব মানুষকে চক্রগুলোর কাছে আবার বিক্রি করে দিত একশ্রেণির অসাধু পুলিশ।
অবশ্য ১ মে পাচারবিরোধী অভিযান শুরুর পর চক্রগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ থাকার সন্দেহে থাই সরকার ইতিমধ্যে উপকূলবর্তী তিন প্রদেশের ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলেও গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া থাই সরকার মানব পাচারে জড়িত সন্দেহে ৭৭ জনকে শনাক্ত করেছে। যাঁদের অনেকে প্রদেশের রাজনীতিক ও প্রাদেশিক সরকারের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি। তাঁদের মধ্যে ৪৬ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
যেভাবে শুরু: সরকারের নানামুখী অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন দেশান্তরি হচ্ছে অনেক আগে থেকে। তবে কাঠের নৌকায় উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার শুরু আড়াই দশক আগে।
কয়েক দশক ধরে থাইল্যান্ডে বাস করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি জানালেন, তাঁদের জানা মতে, আরাকান থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডে প্রথম নৌকাটি আসে ২০০০ সালে। তাতে আরোহী ছিল ১৭ জন রোহিঙ্গা। নৌকাটি ছিল আরাকানের বাসিন্দা তসর মুল্লুকের। তিনি মূলত মিয়ানমার থেকে নৌকায় কাঠ পরিবহন করতেন। তাঁর নৌকায় এরপরও কয়েক দফায় তাঁর নিজ গোত্রের লোকজন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া গেছেন। তবে অল্পসংখ্যক।
এরপর গাছ বা কাঠবাহী ইঞ্জিন নৌকায়ও কিছু কিছু রোহিঙ্গা সাগরপথে দেশ ত্যাগ করেন। তাঁরা মূলত নিজ গোত্রের লোকদের আশ্রয়ে উঠতেন। থাইল্যান্ডে সুবিধা করতে না পারলে স্থলসীমান্ত পার হয়ে মালয়েশিয়া চলে যেতেন।
রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের নেতারা জানান, ২০০৫ সাল থেকে সাগরপথে রোহিঙ্গাদের পাচার ‘বাণিজ্যে’ রূপ নেয়। তখন মূলত থাইল্যান্ডের মাছ ধরার নৌকাগুলো ফেরার পথে লোক আনা শুরু করে। এটাকে কেন্দ্র করে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের কিছু সংঘবদ্ধ দালাল চক্র তৈরি হয়।
‘বাণিজ্যের’ বিস্তার: ২০০৮ সালে এ ‘বাণিজ্যের’ বিস্তার ঘটে। বাড়ে দালাল চক্রের সংখ্যা। যুক্ত হতে থাকে থাইল্যান্ডের স্থানীয় প্রভাবশালীরাও। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, তখন পর্যন্ত সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে মৃত্যু এবং স্থলভাগে পুলিশের হাতে আটক হওয়া ছাড়া অন্য কোনো ঝুঁকি ছিল না। স্থানীয় দালালেরা লোক জোগাড় করার পর থাইল্যান্ড থেকে মাছ ধরার ট্রলার পাঠানো হতো। ট্রলারে এনে থাই উপকূলে নামিয়ে স্থলপথে মালয়েশিয়া পাঠানো হতো।
নতুন মাত্রা মুক্তিপণ আদায়: জঙ্গলে ক্যাম্প করে মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, এক চক্রের কাছ থেকে আরেক চক্রের কাছে বিক্রি—এসব শুরু হয় ২০১২ সাল থেকে। এ সময় থেকে এমএলএম (বহুস্তর বিপণন) কোম্পানির মতো আরাকান ও বাংলাদেশের ভেতর দালাল চক্রের নেটওয়ার্ক বাড়তে থাকে। থাইল্যান্ডের মাছ ধরার অনেক ট্রলারের মালিক তাঁদের নৌযানের কাঠামো পাল্টে মানুষ পাচারের উপযোগী করেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এমন কয়েকজন সন্দেহভাজন ট্রলার মালিক থাই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণও করেছেন।
২০১২ সালে পাচার বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের হয়ে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতায় যুক্ত মামুন রশিদ বলেন, মিয়ানমার সরকারের প্রশ্রয়ে ওই বছর রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের আক্রমণে অনেক রোহিঙ্গা মুসলমান মারা যায়। অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়। সোয়া লাখের ওপর মানুষ বাস্তুহারা হয়। তখন দলে দলে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে দেশ ছাড়ে। এটাকে পুঁজি করে পাচারকারী চক্রের কারবার আরও ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তারা অসহায় মানুষকে জঙ্গলে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় শুরু করে।
রোহিঙ্গারা টাকা দেয় কোথা থেকে? জবাবে মামুন রশিদ বলেন, অনেকে শেষ শিকড় বসতভিটা বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করে। অনেকে ধারদেনা করে। যারা টাকা দিতে পারে না, তাদের মাসকে মাস আটকে রাখা হয়। অনেকে নির্যাতন সইতে না পেরে মারা গেছে।
টার্গেট হলো বাংলাদেশিরাও: পাচারকারী চক্রের অনেকের সঙ্গে পরিচিত বা ঘনিষ্ঠ ব্যাংককে থাকেন এমন একজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূল থেকে ২০০৮ সাল থেকে সাগরপথে মানুষ আসছিল। তাদের একটা অংশ ছিল বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাকিরা কক্সবাজার বা আশপাশের বাসিন্দা। ২০১০-১১ থেকে বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে তা হয় কয়েক গুণ।
দালাল চক্রকে ধরিয়ে দিতে পুলিশকে সহায়তা করা রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত এক থাই নাগরিক বলেন, রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে বেশি টাকা পাওয়া যায় না। অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেললেও টাকা বের হয় না। কিন্তু বাংলাদেশিদের পেটালে সহজে টাকা মেলে। আর, বাংলাদেশ থেকে হুন্ডিতে টাকা আনাও সহজ। এ কারণে পাচারকারী চক্রগুলো বাংলাদেশিদের ওপর নজর বাড়ায়। ফলে দুই বছরের মাথায় সাগরপথে আসা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যায়।
তিন বছরে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন: থাইল্যান্ডের দক্ষিণে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো ঘুরে এবং এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল অনেক সূত্র থেকে জানা গেছে, মানব পাচার ও টাকা আদায়ের মূল লেনদেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে হলেও এ টাকার বড় অংশ চলে যায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত চক্রপ্রধানদের কাছে।
ফর্টিফাই রাইটসের তথ্যমতে, এই অঞ্চলে ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মানব পাচারে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার (২৫ কোটি মার্কিন ডলার) লেনদেন হয়েছে।
মানব পাচারবিরোধী তদন্তে পুলিশকে সহযোগিতা করা থাইল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন ফ্রিল্যান্ড ফাউন্ডেশন বলেছে, একটি নৌকায় কোনোভাবে ৪০০ জনকে তুলতে পারলে পাচারকারীরা ছয় কোটি টাকা (আট লাখ ডলার) পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করতে পারে।
অবশ্য বাংলাদেশিদের পাচার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশিদের আটকের পর জনপ্রতি নিম্নে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এ প্রতিবেদক থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দিশালায় আটক যেসব বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের কেউ ২ লাখ ২০ হাজার টাকার নিচে দেননি। জনপ্রতি ২ লাখ টাকা ধরলেও ৪০০ জন বাংলাদেশিকে তুলতে পারলে পাচারকারীরা অন্তত আট কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করতে পারে।
জাতিসংঘের হিসাবে, কেবল চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সাগরপথে পাচার হয়েছে। যার অর্ধেক বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। জনপ্রতি দুই লাখ টাকা হিসাবে এ তিন মাসেই ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আর এর অর্ধেক ২৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশে লেনদেন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের সঙ্গে এখন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িয়ে আছে। এর সঙ্গে কেবল বাংলাদেশ নয়—থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দানেশিয়ার চক্র জড়িত। এদের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর দিয়ে মানব পাচারকারী চক্রেরও নেটওয়ার্ক থাকতে পারে। তাই এ-সংকটের সমাধান করতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে হবে। পাচারকারীদের কোথায় কোথায় যোগসূত্র আছে, সেটি খুঁজতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।