এক নজরে ৫ বছর

গত জরিপগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথম দুই বছর ছিল মহাজোট সরকারের সেরা সময়। তৃতীয় বছর থেকে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে মানুষ সমালোচনা-মুখর হতে শুরু করে। নানা ক্ষেত্রে সরকারের জনসমর্থন পরের বছরগুলোতে ক্রমশ কমতে থাকে।

সরকারের কার্যক্রম ও রাজনীতি

দেশ কোথায় যাচ্ছে

অধিকাংশ মানুষ মনে করেন দেশ ভুল পথে চলেছে। সরকারের ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরের শেষে এসে ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন দেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০১১ সালের শেষে এ হার কমে ৬১ শতাংশ হয়ে ৪২ শতাংশে নেমে আসে। এর পর থেকে এ হার নিচের দিকেই থেকে গেছে। ২০১২ সালের শেষে এবং বর্তমান জরিপে কমবেশি ৬০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, দেশ ভুল পথে এগোচ্ছে।

সার্বিকভাবে দেশ পরিচালনা

সামগ্রিকভাবে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ভাটার দিকে গড়িয়েছে। ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরের শেষে ৬৬ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, সরকার সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু পরের বছরই এ ক্ষেত্রে জনমত কমে ৫৮ শতাংশে নেমে আসে। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে এ ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা আরও কমে ৪৩ শতাংশে নেমে আসে। গত বছর ২০১২ সালে তা কিছুটা বেড়ে ৪৬ শতাংশ হলেও এ বছর তা আবারও কমে ৪৩ শতাংশে চলে এসেছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট নন। বর্তমান সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে ৩৯ শতাংশ মানুষ ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন। ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং ১৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। সরকারের প্রথম বছরের শেষে পরিচালিত জরিপে ৬৫ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকায় খুশি ছিলেন।

দুর্নীতির মাত্রা

এবারের জরিপে দেশের দুর্নীতি আরও বেড়েছে বলে মানুষ মনে করছেন। বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়েছে বলে মতামতে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০০৯ সালের শেষে মাত্র ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করতেন দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। বর্তমান জরিপে এ মত দিয়েছেন ৫৪ শতাংশ মানুষ। পক্ষান্তরে ২০০৯ সালের শেষদিকে ৪২ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন দেশে দুর্নীতি কমেছে এবং ২৩ শতাংশ বলেছিলেন দুর্নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এবারের জরিপে ৩৪ শতাংশ মানুষ বলেছেন দেশে দুর্নীতি কমেছে এবং ১২ শতাংশ বলেছেন দুর্নীতির পরিস্থিতি অপরিবর্তিত।

দলীয়করণ

দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলীয়করণ নিয়ে সরকারের প্রতি মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেননি। পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলীয়করণকে উত্তরদাতাদের তুলনা করতে বলা হয়েছিল। সরকারের প্রথম বছরের শেষে ৪১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, দলীয়করণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এবারের জরিপে এ হার বেড়ে ৫৯ শতাংশ হয়েছে। ২৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন দলীয়করণ কমেছে, ১৫ শতাংশ বলেছেন অপরিবর্তিত আছে।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠন

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষ সন্তুষ্ট নন। তাদের ব্যাপারে এই নেতিবাচক মনোভাব বিগত বছরগুলোতে ক্রমেই বেড়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তৎপরতায় মানুষের অসন্তোষের যে হার সরকারের সূচনা বছর ২০০৯ সালের শেষে ছিল ২৯ শতাংশ, এবারের জরিপে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশ। পক্ষান্তরে এই সময়ে তাদের তৎপরতায় খুশি, এমন মানুষের হার ৫৯ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও রাজনীতি

যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তি

সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমর্থনে পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা এ অপরাধ করেছে, তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া উচিত কি না, সে প্রশ্নে দশজন মানুষের মধ্যে আটজনই (৮০ শতাংশ) বিচারের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর বিরোধিতা করেছেন মাত্র ১৯ শতাংশ মানুষ। ২০০৯ সালে পরিচালিত জরিপে বিচার ও শাস্তির পক্ষে ছিলেন ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা।

বিচারপ্রক্রিয়া কি ঠিকভাবে চলছে

বেশির ভাগ মানুষ (৫৯ শতাংশ) মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া ঠিকভাবে চলছে না। ৪০ শতাংশ মানুষ বিচারপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে চলছে বলে মত দিয়েছেন। অথচ ২০১০ সালে ৫৭ শতাংশ মানুষ সরকার এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে বলে মনে করতেন।

যুদ্ধাপরাধের রায় নিয়ে বিএনপির নীরবতা

বিএনপি যে যুদ্ধাপরাধের রায়ের ব্যাপারে নীরব, সে প্রসঙ্গে জাতিকে সাধারণভাবে বিভক্ত মনে হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে বিএনপির নীরবতাকে সমর্থন করেননি অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি (৫৫ শতাংশ) মানুষ। শহরাঞ্চলের উত্তরদাতাদের মধ্যে এ হার অপেক্ষাকৃত বেশি। পক্ষান্তরে ৪৪ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বিএনপির নীরব থাকাই যথাযথ।

১০

রায়-পরবর্তী সহিংসতা এবং জামায়াতের ধ্বংসযজ্ঞ

যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন ব্যাপকসংখ্যক মানুষ। ৮৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন, এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ তাঁরা মোটেই সমর্থন করেন না। জামায়াতের এ জাতীয় কর্মকাণ্ড মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ সমর্থন করেছেন। রায়-পরবর্তী সহিংসতাকে তুলনামূলকভাবে গ্রামের মানুষ বেশি সমর্থন করেন।

১১

জামায়াত নিষিদ্ধকরণ

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেননি। ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে এবং বাকি ৭০ শতাংশ বিপক্ষে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে পরিচালিত জরিপেও ৬৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে ছিলেন। নিষিদ্ধ করার পক্ষে তখন ছিলেন ২৫ শতাংশ মানুষ। উল্লেখ্য, জামায়াতের জনসমর্থন এবারের জরিপেও কমেছে। তাই ধারণা করা যায়, যাঁরা জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক নন, তাঁদেরও অনেকে ভিন্নতর বিবেচনায় তাদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। এমনকি আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে ইচ্ছুকদের মধ্যেও ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেননি।

১২

বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ

বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের আচরণকে বেশির ভাগ মানুষ ভালো বলে মনে করছেন না। এবারের জরিপে ৭৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে সঠিক আচরণ করছে না। অথচ এ সরকারের প্রথম বছরের শেষে এ মত দিয়েছিলেন ৪২ শতাংশ মানুষ। বিরোধী দলের সঙ্গে সরকার ভালো আচরণ করছে বলে ২০০৯ সালে মত দিয়েছিলেন ৫৭ শতাংশ মানুষ। এবারের জরিপে এ ধারণার পক্ষে জনমত ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন

১৩

নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য

অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য নিয়ে ২০১২ সালের শেষে পরিচালিত জরিপের মতো এবারও দেশবাসীকে কমবেশি বিভক্ত দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য নিয়ে ৪৮ শতাংশ মানুষ ইতিবাচক ও ৫১ শতাংশ নেতিবাচক মত দিয়েছেন। আগের জরিপে এ মতামত ছিল যথাক্রমে ৪৫ ও ৪৯ শতাংশ।

১৪

সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কী বলে

অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয় নির্বাচনের আগাম প্রতিফলন ঘটেছে। ৩৭ শতাংশ মানুষ তা মনে করেননি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী মত দিয়েছেন। বিএনপিকে ভোট দিতে চান, এমন ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগাম ছায়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পড়েছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগে ভোট দিতে ইচ্ছুক উত্তরদাতাদের ২২ শতাংশ তা মনে করেন।

১৫

নির্বাচনে সেনা-সহায়তার প্রয়োজন

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রায় সব উত্তরদাতা জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাওয়ার ক্ষেত্রে একমত। গত বছরের মতো এবারও প্রতি দশজন উত্তরদাতার মধ্যে প্রায় নয়জন সেনাবাহিনীর সহযোগিতার পক্ষে মত দিয়েছেন।

১৬

বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা

বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করছেন দশজনের মধ্যে নয়জন উত্তরদাতা। এর বিপরীত মত পোষণ করেছেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ। এমনকি আওয়ামী লীগকে যাঁরা ভোট দিতে চান, তাঁদের মধ্যেও ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণা, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।

১৭

নির্বাচনী সরকার প্রশ্নে আ.লীগ ও বিএনপি সমঝোতা

২০১২ সালের তুলনায় এবারের জরিপে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার ব্যাপারে মানুষের আশাবাদ বেড়েছে। ৪৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যাশা করছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হবে। ২০১২ সালের শেষ পর্যায়ের জরিপে এ হার ছিল ৩৪ শতাংশ। তবে এখনো ৫৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এ দুই দলে সমঝোতা হবে না।

১৮

সমঝোতা না হলে কী হবে

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা না হলে নৈরাজ্যের আশঙ্কা করছেন দেশের অধিকাংশ মানুষ। ৭৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, দুই প্রধান দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশে নৈরাজ্য দেখা দেবে। বাকিদের মধ্যে ১৪ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, সমঝোতা না হলে দেশে সামরিক বা সেনা-সমর্থিত সরকার চলে আসতে পারে। ১২ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে পারে বলে মত দিয়েছেন।

১৯

মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সরকারের ভূমিকা

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে সরকারের ভূমিকার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এবারের জরিপে সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন ৬৯ শতাংশ মানুষ। ২০১২ সালের জরিপে ৬০ শতাংশ মানুষ এ মত দিয়েছিলেন। এবার তা ৯ শতাংশ বেড়েছে।

২০

ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে তারেক রহমান ও সজীব ওয়াজেদ জয়

দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে মানুষের ধারণা মিশ্র। ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, তারেক রহমান দেশে ফিরে রাজনীতি শুরু করলে তা দেশের জন্য ভালো হবে। ২০১২ সালে এমন ধারণার পক্ষে ছিলেন ৪২ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে ৫৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ দেশের জন্য ভালো হবে। পক্ষান্তরে তারেক রহমান ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতি করার ব্যাপারে যথাক্রমে ৩৯ ও ৪৪ শতাংশ মানুষ নেতিবাচক মত দিয়েছেন।