জনসমর্থনে বিএনপি এগিয়ে

কার্টুন : শিশির
কার্টুন : শিশির

দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চেয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বেশি।
এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে দেশের অর্ধেক মানুষ (৫০ দশমিক ৩ শতাংশ) বিএনপিকে ভোট দিতে চান। আর আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চান ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। জনসমর্থন হারিয়েছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও জামায়াতে ইসলামী। প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে এ ফলাফল উঠে এসেছে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে প্রথম আলোর উদ্যোগে ষষ্ঠবারের মতো জনমত জরিপ করা হলো। এ জরিপের মাঠপর্যায়ের কাজ চলে গত সেপ্টেম্বর মাসে। বর্তমান সরকারের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো প্রতিবছরের শেষে এ জরিপ করে আসছে। এ বছরের এপ্রিলে চলমান গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত একটি বিশেষ জরিপও করা হয়েছিল।
সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১২ সালের নভেম্বরে পরিচালিত জরিপে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন পাওয়া গিয়েছিল ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। গত ১০ মাসে তা সাড়ে ৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। পক্ষান্তরে একই সময়ে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বেড়েছে প্রায় ২ পয়েন্ট। আওয়ামী লীগ এককভাবে সমর্থন আদায় করেছে প্রায় ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের। ১০ মাস আগে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ছিল ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে জনসমর্থনের ব্যবধান ক্রমাগত বেড়েছে।

সাম্প্রতিক কয়েক মাসে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) যথেষ্ট পরিমাণে জনসমর্থন হারিয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে জাতীয় পার্টির প্রতি জনসমর্থন ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, এখন নেমে এসেছে ৭ শতাংশে। তাদের হারিয়ে যাওয়া নিজস্ব জনসমর্থন প্রায় ৪১ শতাংশ। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের গোঁড়া ও একনিষ্ঠ বলে ধারণা করা হলেও তাদের জনসমর্থনও ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে তারা নিজস্ব জনসমর্থন হারিয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। এবারের জরিপে এ দুই দলের ভোট আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে চলে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

জরিপে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সমর্থক বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে অপেক্ষাকৃত বেশি। বিএনপির সমর্থক বেশি বরিশাল ও রাজশাহীতে। জাতীয় পার্টি রংপুরেই বেশি জনপ্রিয়। জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি খুলনা।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই সমর্থক শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে বেশি। আওয়ামী লীগের পুরুষ সমর্থক বেশি, বিএনপির বেশি নারী সমর্থক। নিজ সমর্থকদের ভেতরে আওয়ামী লীগ বেশি জনপ্রিয় চল্লিশোর্ধ্বদের মধ্যে। বিএনপির জনপ্রিয়তা তার সমর্থকদের ভেতরে ৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে বেশি।

ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেও ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা তাদের নেই। তবে ৪৮ শতাংশ মানুষ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রেখেছেন। দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়া আগামী সাধারণ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে ইচ্ছুকদের মধ্যেও ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন।

সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন হবে বলে মত দিয়েছেন ৮৮ শতাংশ মানুষ।

জরিপে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে প্রতি দশজনের মধ্যে অন্তত আটজন (৮০ শতাংশ) মানুষ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তবে বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের মনোভাব মিশ্র। ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বিচার যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় প্রশ্নে বিএনপির নীরবতা নিয়ে মানুষের মতামত প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি উত্তরদাতা তাদের নীরবতা সমর্থন করেননি। অর্ধেকের সামান্য কম উত্তরদাতা বলেছেন, এ নীরবতা যথাযথ।

দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিয়ে জনমত বেশ জটিল। এবারের জরিপে জামায়াতের জনসমর্থন ৩ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছেন ৭০ শতাংশ মানুষ। এমনকি আওয়ামী লীগকে যাঁরা ভোট দিতে চেয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেননি।

ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাথায় রেখে পরিচালিত এ জরিপের ফলাফলের সঙ্গে গত চারটি জরিপের ফলাফলের তুলনা করলে দেখা যায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দুই বছর ছিল এ সরকারের সেরা সময়। দেশবাসীর বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রথম দুটি বছর সরকার জনসমর্থন উপভোগ করে। তৃতীয় বছরে এসে তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমতে শুরু করে। বহু ক্ষেত্রে তাদের জনসমর্থনের হার গত তিন বছরে আর ওপরে উঠে আসেনি।

এবারের জরিপে ৫৭ শতাংশ মানুষ সামগ্রিকভাবে সরকার পরিচালনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, দেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে না।

দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে সরকারের ভূমিকা সমর্থন করেননি।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দলের সমঝোতার ব্যাপারে মানুষের আশাবাদ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ৪৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যাশা করছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হবে। তাদের মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশে নৈরাজ্য শুরু হবে, এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ৭৩ শতাংশ মানুষ।