স্থলসীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও সম্পর্কিত বিষয়সংক্রান্ত চুক্তিটির বাংলা ভাষান্তর নিচে দেওয়া হলো (যা পরবর্তী সময়ে স্থলসীমান্ত আইন ১৯৭৪ নামে গৃহীত হয়েছে):

নয়াদিল্লি, মে ১৬, ১৯৭৪

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত সরকার দুটি দেশের মধ্যকার বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্টভাবে স্থলসীমানা চিহ্নিত ও তা সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত বিষয়ে মতৈক্যে এসেছে:

ধারা ১ : নিম্নোক্ত অঞ্চলগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থলসীমানা চিহ্নিত করা হবে এভাবে:

১. মিজোরাম-বাংলাদেশ সেক্টর; সীমানা চিহ্নিত করা হবে দেশ বিভাগপূর্ব সময়ে জারি করা সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি ও রেকর্ডের ভিত্তিতে।

২. ত্রিপুরা-সিলেট সেক্টর: মতৈক্যের ভিত্তিতে এ অঞ্চলে যে সীমানা চিহ্নিতকরণ চলছে, তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে।

৩. ভাগলপুর রেলওয়ে লাইন: রেলওয়ে পূর্বাভিমুখী বাঁধের গোড়া থেকে ৭৫ ফুট দূরে সমান্তরালভাবে সীমানা চিহ্নিত করতে হবে।

৪. শিবপুর-গৌরাঙ্গালা সেক্টর: ১৯১৫-১৮ সালের ডিস্ট্রিক্ট সেটেলমেন্ট ম্যাপগুলোর ভিত্তিতে ১৯৫১-৫২ সালে সীমানা চিহ্নিতকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় এটা সম্পূর্ণ করতে হবে।

৫. মুহুরী নদী-(বিলোনিয়া) সেক্টর: মুহুরী নদীর মাঝখানের স্রোতের ধার ঘেঁষে এই অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত শুরু করতে হবে। এটি হবে নির্ধারিত সীমানা। নদীটিকে বর্তমান ধারায় প্রবাহিত করার লক্ষ্যে দুই সরকারকেই নিজেদের এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। যাতে নদীটির গতিপথ স্থিতিশীল হয়।

৬. ত্রিপুরা-নোয়াখালী/কুমিল্লা সেক্টরের অবশিষ্ট অংশ: ১৮৯২-৯৪ সালের চাকলা-রোশানাবাদ এস্টেট মানচিত্র এবং ১৯১৫-১৮-এর ডিস্ট্রিক্ট সেটেলমেন্ট ম্যাপে চাকলা-রোশানাবাদের যেসব এলাকা অন্তর্ভুক্ত হয়নি তার ভিত্তিতে এই সেক্টরের সীমানা চিহ্নিত করতে হবে।

৭. ফেনী নদী: ১৯৩৫ সালের সার্ভে অব ইন্ডিয়া ম্যাপ শিট নম্বর ৭৯এম/১৫ প্রথম সংস্করণে যে ফেনী নদী নির্দেশ করা হয়েছে, সেই ফেনী নদীর মধ্য স্রোতের ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। ওই মানচিত্রের যে জায়গায় এটি আশালং সি হিসেবে আরেকটি স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তার আগে পর্যন্ত এটি প্রযোজ্য হবে। আর সেখান থেকে ফেনী নদীর ভাটিতে প্রবাহের মাঝখানে সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। এটি নির্ধারিত সীমান্ত হবে।

৮. ত্রিপুরা-পার্বত্য চট্টগ্রাম সেক্টর অবশিষ্ট: গ্রিড রেফারেন্স ০০৯৭৭৯ পর্যন্ত ফেনী নদীর সেই শাখার মধ্য স্রোতের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারিত হবে, যেটা ৭ নম্বর প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেখান থেকে সীমানা নির্ধারিত হবে পূর্বতম উপনদীর মধ্যস্রোত অনুসারে। এই উপনদীর উৎস থেকে উপর্যুক্ত মানচিত্রে বায়ান আশালং হিসেবে চিহ্নিত স্রোতের স্বল্পতম দূরত্বে সীমানা চিহ্নিত করা হবে। আর সেখান থেকে তা সাধারণত উত্তর অভিমুখে এই নদীর মধ্য স্রোত ঘেঁষে প্রবাহিত হবে, যেখানে সেটি ঢাল-মধ্যবর্তী উৎসে পৌঁছায় তার আগে পর্যন্ত (উল্লিখিত মানচিত্রে যা গ্রিড রেফারেন্স ০৪৬৮১০ হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে)। সেখান থেকে বঘোবান ট্রিগ স্টেশন পর্যন্ত এই ঢাল মধ্যবর্তী উঁচু এলাকার চূড়া ঘেঁষে এটি চিহ্নিত করা হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশ-আসাম-ত্রিপুরা সীমান্ত (খানতালাং ট্রিগ স্টেশন) পর্যন্ত সীমানা চিহ্নিত হবে দুই দেশের নদী সন্ধিক্ষণ ধরে। মানচিত্র ও ভূমির মধ্যে পার্থক্য দেখা গেলে ভূমিই টিকে যাবে। এই সেক্টরে সীমানা হবে নির্ধারিত।

৯. বিয়ানীবাজার-করিমগঞ্জ সেক্টর: উমাপাতি গ্রামের পশ্চিম অংশের যে সীমানা অচিহ্নিত আছে, তা এই চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে সৃষ্ট মতৈক্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করতে হবে। আর উমাপাতি গ্রামকে ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।

১০. হাকার খাল: এই সীমানা চিহ্নিত করা হবে ১৯৫৮ সালের নেহরু-নূন চুক্তির আলোকে। এতে হাকার খালকে ভৌগোলিকভাবে ইছামতী নদী থেকে পৃথক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটি হবে নির্ধারিত সীমানা।

১১. বাইকারি খাল: বাইকারি খালের সীমান্ত চিহ্নিত করতে হবে ১৯৪৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ বিভাগের পরিচালকদের মধ্যকার মতৈক্যের ভিত্তিতে। এটি হবে নির্ধারিত সীমানা।

১২. ছিটমহল: বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল ও ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় হবে। প্যারাগ্রাফ ১৪-তে উল্লিখিত ছিটমহলগুলো বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছে বাড়তি অঞ্চল যাওয়ার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করা হবে না।

১৩. হিলি: র‍্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড ও মানচিত্রে তিনি যে লাইন এঁকেছিলেন, তার ভিত্তিতে এই এলাকার সীমানা চিহ্নিত হবে।

১৪. বেরুবাড়ি: ভারত ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণের অর্ধেক অংশ পাবে, এর আয়তন প্রায় ২ দশমিক ৬৪ বর্গকিলোমিটার। এর বিনিময়ে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশে থেকে যাবে। আর দহগ্রামের সঙ্গে পানবাড়ি মৌজার সংযোগের জন্য তিনবিঘার কাছে ভারত বাংলাদেশকে ১৭৮ মিটার x ৮৫ মিটার জায়গা চিরতরে ইজারা দেবে।

১৫. লাঠিটিলা-দুমাবাড়ি: ওয়াই পয়েন্ট থেকে (ভূমি চিহ্নিতকারী সীমানা স্তম্ভ) দক্ষিণ অভিমুখে সীমানা চিহ্নিত হবে পাঠিয়ারা পাহাড়ের আরএফ সীমানা ঘেঁষে সেই জায়গা পর্যন্ত, যেখানে এটি দুমাবাড়ি মৌজার পশ্চিম সীমান্তে মিলিত হয়। তারপর সেই একই মৌজা সীমান্ত ঘেঁষে দুমাবাড়ি, লাঠিটিলা ও বড় পুঁটিগাঁও মৌজাগুলোর জংশনের সীমানা চিহ্নিত হবে দুমাবাড়ি ও লাঠিটিলা মৌজার মধ্য দিয়ে। সেখান থেকে সবচেয়ে স্বল্প পথ ধরে এটি এগিয়ে গিয়ে পুতনিছড়ার মধ্য স্রোতে সেই জায়গায় মিলবে, যেখানে সিলেট ও ত্রিপুরার সীমানা মিলেছে।

ধারা ২: ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে সীমানা চিহ্নিত হয়ে যাওয়া এলাকায়, যার ভিত্তিতে বাউন্ডারি স্ট্রিপ ম্যাপ প্রস্তুত হয়েছে, যেসব অপদখলীয় জমি আছে, বাউন্ডারি স্ট্রিপ ম্যাপে স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে সেগুলো রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে বিনিময় হবে। প্রাসঙ্গিক মানচিত্রে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাতে স্বাক্ষর করবে, তবে কোনোভাবেই তা ১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে নয়। যেসব এলাকার সীমানা ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়ে গেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানচিত্র ছাপানোর জন্য আশু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। ৩১ ‌ডিসেম্বর ১৯৭৫ তারিখের মধ্যে এই মানচিত্র ছাপাতে হবে এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তাতে সই করতে হবে, যাতে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালের মধ্যে অপদখলীয় জমি বিনিময় সম্ভব হয়। যেসব সেক্টরের সীমানা এখনো চিহ্নিত হয়নি, সেখানে বাউন্ডারি স্ট্রিপের মানচিত্রে কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে এই ভূমি বিনিময় সম্পন্ন হতে হবে।

ধারা ৩: বাংলাদেশ ও ভারত সরকার এ মর্মে একমত যে ভূমি বিনিময় হয়ে গেলে ছিটমহলের মানুষেরা যাঁরা যেখানে ছিলেন, তাঁরা সেখানেই থাকার অধিকার পাবেন, যে রাষ্ট্রের কাছে ভূমি স্থানান্তর হয়েছে, সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে। সীমানা চিহ্নিত হওয়া এবং বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত বিরাজমান পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। আর সীমান্ত এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিরাজ করবে। দুই দেশই এ লক্ষ্যে সীমান্ত এলাকায় তাদের স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে।

ধারা ৪: বাংলাদেশ ও ভারত সরকার এ ব্যাপারে একমত যে এই চুক্তির ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তা সমাধান করা হবে।

ধারা ৫: এই চুক্তিতে উভয় দেশকেই অনুসমর্থন দিতে হবে এবং যত শিগগির সম্ভব সেই দলিল বিনিময় হতে হবে, আর চুক্তিটি কার্যকর হবে দলিল হস্তান্তরের দিন থেকে।

নয়াদিল্লিতে ১৬ মে, ১৯৭৪-এ এই দলিলের দুটি আসল কপি স্বাক্ষরিত হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে                                   গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের পক্ষে

(শেখ মুজিবুর রহমান)                                                              (ইন্দিরা গান্ধী)

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী                                                            ভারতের প্রধানমন্ত্রী

দ্রষ্টব্য: পরবর্তী সময়ে এই চুক্তির কোনো পরিবর্তন করা হয়ে থাকলে এখানে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

সূত্র: বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক; মোহাম্মদ সেলিম