সীমান্ত চুক্তির মতো তিস্তাও হবে, একটু সময় চান মোদি

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল বঙ্গভবনের দরবার হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সৌজন্যে
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল বঙ্গভবনের দরবার হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সৌজন্যে

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ৪১ বছরের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছেন। শুধু তাঁর দল বিজেপিই নয়, ভারতের সংসদে সবগুলো দল নিয়ে সর্বসম্মতভাবে সীমান্ত চুক্তি বিল পাস করিয়েছেন। তিস্তা চুক্তিও সেভাবেই করতে চান তিনি। এ জন্য তাঁকে কিছুটা সময় দিতে হবে।
গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের সময় অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বললেন নরেন্দ্র মোদি। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমন ও নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। কারণ, এর সুফল সরাসরি ভোগ করছে ভারত।
নরেন্দ্র মোদি ওই দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার পাশাপাশি একান্তে এবং কয়েকজনের উপস্থিতিতে আরও
দুই দফা আলোচনা করেন। সীমান্ত চুক্তি, তিস্তা চুক্তি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বাংলাদেশের জন্য শুভ কামনা, দুই দেশ এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ—এসব বিষয়ও আলোচনায় আসে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল রোববার সকালে প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানান। সামগ্রিকভাবে আলোচনার মুল সূর ছিল বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা। মোদির আলোচনায় ভারতের পক্ষ থেকে অনেক বেশি উষ্ণতার ছাপ ছিল।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত দুই কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিটি সইয়ে শেখ হাসিনাকে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন নরেন্দ্র মোদি। সীমান্ত চুক্তি যেভাবে সমাধান করেছেন, তিস্তার সমাধানও সব পক্ষকে নিয়ে সেভাবেই করবেন তিনি। বিষয়টি সুরাহার জন্য কিছুটা সময় চান তিনি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, পানির তো কোনো সীমানা নেই। এটি একটি মানবিক বিষয়, যা মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাতাস ও পাখির মতো পানিও কোনো সীমানা মানে না। নদীর বিষয়টিকে মানবিক উল্লেখ করে তিনি সামগ্রিকভাবে নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়েছেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনো কখনো হিন্দিতে কথা বলেন মোদি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মোদি যে নতুন স্তরে নিতে চান, কাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সব বৈঠকেই সে আভাস দিয়েছেন। মোদি দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছেন, দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে অমীমাংসিত কোনো বিষয় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। একাত্তরে রক্তের মাধ্যমে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, তা অটুট থাকবে চিরকাল। কূটনীতি কিংবা অন্য কিছুই এ বন্ধনে ফাটল ধরাতে পারবে না। বাংলাদেশের উন্নতিকে তিনি ভারতের উন্নতি হিসেবে দেখেন। কারণ, বাংলাদেশে বৃষ্টি হলে তার হিমেল বাতাস তো ভারতেও বইবে।
নিরাপত্তা প্রসঙ্গ আলোচনায় এলে মোদি বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের সহযোগিতার প্রশংসা করেন। মোদি বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে শেখ হাসিনা ন্যূনতম ছাড় দেননি। এর ফলে সরাসরি লাভবান হয়েছে ভারত। এ জন্য তিনি বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারে উষ্ণতার পাশাপাশি আন্তরিকতাও বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। তিনি বারবার দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর তাগিদ দিয়ে বুঝিয়েছেন, সম্পর্কের স্বার্থে দুই পক্ষেরই একে অন্যকে সুবিধা দেওয়া উচিত।
গওহর রিজভী বলেন, দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি উপ আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির চিন্তায় বাংলাদেশের ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।
জানা গেছে, মোদি তাঁর আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাফল্যই যেন ভারতের সাফল্য, এভাবেই তিনি দেখতে চান। নেপালের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ টেনে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভূমিকম্পের তাণ্ডবে নেপালে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। অবকাঠামোসহ সব কিছু পুনর্গঠন তো দেশটির একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই নেপালের জন্য সবার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে ত্রিপুরায় জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যশস্য পরিবহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, সংকটকালে মানবিক মূল্যবোধই যে সব কিছু ছাপিয়ে যায়, বাংলাদেশের এ সহযোগিতা তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ওই সময় বাংলাদেশ হয়ে খাদ্যশস্য পাঠানো না হলে ত্রিপুরায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিত।
জানা গেছে, সম্প্রতি চীন সফরের সময় তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে মোদিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। পাশের দেশ বাংলাদেশে এত জনসংখ্যা, তারাই কিনা তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মোদি তখন বললেন, বাংলাদেশের এ অর্জন তাঁকে তৃপ্তি দেয়। আগামী দিনেও বাংলাদেশ এ অবস্থান বজায় রাখুক, এটাই ভারত প্রত্যাশা করে। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি তোলেন মোদি।
গতকালের বৈঠকে সীমান্ত চুক্তি সমাধানের প্রসঙ্গ এলে মোদি কয়েকবার একাত্তর ও বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ টেনেছেন। মোদি বলেন, সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের সময় রাজ্যসভা ও লোকসভায় যতবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আলোচনা হয়েছে, ভারতের সংসদ তো বটেই পৃথিবীর অন্য দেশের সংসদের কোনো আলোচনায় কোনো নেতার নাম এতবার এত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়নি। আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় রচিত ওই আলোচনায় যেন সবাই ফিরে গিয়েছিলেন একাত্তরে। বঙ্গবন্ধু যে বীজ বুনেছিলেন, তাঁর কন্যার শাসনামলে সে বীজটি ফলে পরিণত হয়েছে।
বাণিজ্য বৈষম্যের প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যটা এতটা অসমভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে আছে, বাংলাদেশের উদ্বেগটা একেবারেই যৌক্তিক। এ অবস্থায় থাকলে ভারতের প্রতিক্রিয়া তো এমনই হতো। তবে এ বৈষম্য দূর করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাংলাদেশের দুটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগ হলে তা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এ জন্য মোদি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ শিল্প উদ্যোক্তাদের এখানে আনার উদ্যোগ নেবেন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এর আগেও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, নরেন্দ্র মোদিকে অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। মোদি কূটনীতিক ও আমলাদের পরামর্শ শুনেছেন হয়তো, কিন্তু কথা বলেছেন নিজের মতো করেই। ভেবেচিন্তে সাবলীলভাবেই বলেছেন।