দল স্থবির, নেতারা সক্রিয় কোন্দলে

দীর্ঘ ১০ বছর পর গত বছরের অক্টোবরে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পায় ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগ। সঙ্গে পায় দলীয় কোন্দল। কাউন্সিলের আট মাস পেরিয়ে গেলেও আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনে পৃথক পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা পাঠিয়েছেন কেন্দ্রে। কমিটি হয়ে গেলে কোন্দল কমবে—এ আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের ১৬ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ঘিরে নেতা-কর্মীরা বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর আসনের সাংসদ মো. দবিরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সে সময় কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে রমেশ অনুসারী হিসেবে পরিচিত জেলা পরিষদের প্রশাসক মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশী নির্বাচিত হন।
কিন্তু এরপর থেকে দুই নেতার মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। ফলে নেতা-কর্মীরাও হয়ে পড়েছেন দ্বিধাবিভক্ত। সম্প্রতি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাঁদের পছন্দের নেতাদের নাম দিয়ে জেলার দুই রকম পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন।
এ বিভক্তি শহর থেকে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বিভক্তির প্রভাব শুধু আওয়ামী লীগে নয়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ এমনকি ছাত্রলীগে পড়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সে সময় প্রতিপক্ষের কর্মীদের হাতে রমেশ চন্দ্র সেন, মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশীসহ জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা লাঞ্ছিত হন। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে।
একাধিক জেলা নেতা জানান, সম্মেলনের পর ৫ জানুয়ারির গণতন্ত্র দিবস পালন ছাড়া কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি জেলা কমিটি। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিও পালন করেনি জেলা আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি পালনেও জেলার নেতাদের উৎসাহ ও সম্পৃক্ততা কম ছিল।
জেলা কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জেলার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি হাতে নেওয়া কঠিন বিষয় ছিল না। তবু আমরা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা বলে স্বীকার করে নিতেই হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগে মতভেদ থাকলেও কখনোই কোন্দল ছিল না। গত জেলা কাউন্সিলে জেলার নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে কোন্দলের বীজ বপন করা হয়। তার প্রভাব পড়েছে দলের কর্মকাণ্ডে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবেই থাকতে চাই। কমিটির শীর্ষ পদে না থাকলেও আমি সংগঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছি।’
গত সোমবার সন্ধ্যায় ঠাকুরগাঁও শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনজন বসে টেলিভিশন দেখছেন। তাঁদের মধ্যে একজন কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক অতুল প্রসাদ ও বাকি দুজন আওয়ামী লীগের সমর্থক।
জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, দলের মধ্যে ছোট ছোট গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে সরে আছেন অনেক নেতা। দলকে চাঙা করতে হলে দ্বন্দ্ব ভুলে এক হয়ে কাজ করা জরুরি।
সাধারণ সম্পাদক সাদেক কুরাইশী দলের কার্যালয়ে না বসে জেলা পরিষদ ও ঠাকুরগাঁও রোডের তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সময় দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকলেও পৌরসভা, উপজেলা কমিটির মাধ্যমে সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। জেলা কার্যালয়ে না বসলেও আমি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডগুলো নিয়মিত পরিচালনা করছি।’ তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব থাকায় তার প্রভাব সংগঠনে পড়েছে। কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। তা অনুমোদন পেলেই জেলা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড চাঙা হবে।’
সভাপতি মো. দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ছিল। ভুক্তভোগীরা এই সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পেতে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। আমি সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। এতে দলের ভেতরে পরাজিত ওই গোষ্ঠীর কেউ কেউ আমার ওপর নাখোশ থাকতে পারেন। জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনেও তাঁরাই বিরোধিতা করছেন।’ তিনিও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন হলেই জেলার কর্মকাণ্ডে স্থরিরতা কেটে যাবে।’