জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে নিহত ২৭

বাড়ির বেড়া বলতে ছেঁড়াফাটা পলিথিনের বস্তা টানানো। ভাঙা টিনের পাশাপাশি দুটি ঘরের সামনে একটু খোলা জায়গা। উঁচু জায়গাটিতে পড়ে আছে ইটের টুকরা, ছেঁড়া কাপড়-পলিথিন, খেজুরপাতা। বাড়ির বড় মেয়ে জোছনা বেগম চোখের পানি মুছে জায়গাটি দেখিয়ে বলেন, ‘এই হানেই মায়েরে শেষ গোসল দিছি।’
জোছনা বেগমের মা ফাতেমা বেগম গত শুক্রবার রাতে বাড়ির সবার সঙ্গেই সেহ্রি খেয়েছিলেন। সেহ্রি খেয়ে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন একটি জাকাতের কাপড়ের আশায়। সঙ্গে ছিলেন পাশের বাড়ির আরও তিন নারী। এই চার নারীর তিনজনের ভাগ্যে নতুন শাড়ির বদলে জুটেছে কাফনের কাপড়।
ফাতেমা বেগমের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের মোড়লপাড়ায়। গতকাল শনিবার সকালে সেখানে দেখা হয় ওই চার নারীর মধ্যে বেঁচে যাওয়া মাজেদা বেগমের সঙ্গে। তিনিও মানুষের পায়ের নিচে চাপা পড়েছিলেন। বেঁচে গেছেন সৌভাগ্যক্রমে। ব্যথা পাওয়া পাঁজর ও পা দেখিয়ে মাজেদা বেগম বলেন, ‘সামনে-পিছত বহুত মানুষ। দেড় ঘণ্টা খাড়াইয়া রইছি। গেটটা খুলতেই একটা আওয়াজ, ঘূর্ণিঝড় হয়া গেল। পইড়্যা গেলাম, চোখ-মুখ অন্ধকার হইয়্যা গেল। একজন টাইন্যা তুললে চাইয়া দেহি, আমার লগের তিনজন তিনহানে পইড়্যা আছে।’
শুক্রবার ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী সড়কে শামীম তালুকদারের বাড়িতে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে নিহত হন ২৭ জন। তাঁদের সবাই হতদরিদ্র। নিহত ২২ নারীর বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক। জাকাতদাতার পক্ষ থেকে আগেই কার্ড দেওয়া হলেও বেশির ভাগই ছিলেন কার্ডছাড়া। সবাইকে কাপড়-টাকা দেওয়া হবে শুনে ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন।
মাজেদা বেগম নিজের পরনের কাপড় দেখিয়ে বলেন, ‘এইডাও ভাই মাইনষের দেওয়া। সম্মান ঢাকতে যাইরে, বাবা। যদি খাইতে পারতাম, পিনতাম পারতাম, তাইলে তো যাইয়াম না। খুঁইজা খুঁইজা বোনেরা বোন গোরে লইয়া গেছিল। লাশ হইয়া ফিরত আইল।’
মাজেদা বেগমের পাশের ঘরেই থাকতেন রহিমা বেগম। ছোট মাটির ঘরের সামনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর মেয়ে সালমা ও ছেলে নাঈম। অনেকক্ষণ পর সালমার অস্ফুট স্বর শোনা যায়, ‘তিনজন একসঙ্গে সেহ্রি খাইছি। মায়ে দুধ দিয়া একটুহানি ভাত খাইয়া গেছিল। মইর্যাে যাইব বুঝতে পারলে তো যাইতে দিতাম না।’
মায়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে গলা দিয়ে আর আওয়াজ আসছে না জহুরা বেগমের একমাত্র মেয়ে সামসুন্নাহারের। কোনোমতে শোনা গেল ‘ব্যাক মানুষে গেছে। হেগোরতে হুইন্যা হুইন্যা আমার মা গেছে। ভোরে পাশের বাড়ির চিক্কুর হুইন্যা গিয়া হুনি, মায়ে মইর্যাে গেছে।’