'ত্রাণ নয়, বেড়িবাঁধ সংস্কার চাই'

কক্সবাজারের টেকনাফে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের ত্রাণ দিতে এসে গতকাল রোববার ক্ষোভের মুখে পড়েন সাংসদ আবদুর রহমান বদি। সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রের কয়েক শ নারী ত্রাণের পরিবর্তে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্যও তাঁর কাছে দাবি জানান।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার মানুষ শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তিন বছর আগে পশ্চিমপাড়া এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। কিন্তু বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় তাঁরা প্রতি বর্ষায় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

সাবরাং ইউপির চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান জানান, বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবিতে সাংসদের সামনে আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দাদের ক্ষোভ প্রকাশের বিষয়টি তিনি শুনেছেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পর সাংসদ বদিকে ঘিরে ‘আমরা ত্রাণ চাই না, বেড়িবাঁধ চাই’ বলে স্লোগান দেন নারীরা। তখন সাংসদ  মাথায় হাত তুলে ভবিষ্যতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন।

 পেকুয়া: পেকুয়া উপজেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ঘূর্ণিঝড় কোমেনের আঘাতে উপজেলার মগনামা, উজানটিয়া, শিলখালী ইউনিয়নের কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে।

গতকাল সকালে উজানটিয়া ইউনিয়নের টেকপাড়া, মৌলভীপাড়া, মালেকপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, শত শত ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ভিটার চিহ্ন বোঝাতে কিছু কিছু নারকেলগাছ দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় লবণচাষি কেফায়ত উল্লাহ জানান, পাঁচ গ্রামের পাঁচ শতাধিক মানুষ চার দিন ধরে এই প্রিজম কেন্দ্রে রয়েছে। জোয়ারের সময় সাইক্লোন শেল্টারটি নিচতলা ডুবে যায়।

মৌলভীপাড়ার আমিন উল্লাহ জানান, ‘আমরা ত্রাণসামগ্রী চাই না, দ্রুত ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কার চাই। কারণ বাঁধ থাকলে আমরা চিংড়ি, লবণ, ফসলের চাষ করে বাঁচতে পারব। নইলে বাপ-দাদার এই জন্মভিটিতে কারও থাকা হবে না।’

উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শহিদুল ইসলাম জানান, কয়েক দিনের মধ্যে ভাঙা বাঁধ সংস্কার না করলে পানিতে ডুবে থাকা এই ইউনিয়নের ৩ হাজার ২০০ ঘরবাড়ি রক্ষা করা কঠিন হবে। 

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল মোস্তফা চৌধুরী জানান, ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি। এই ইউনিয়নে ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং ১২ কিলোমিটার আংশিক ভেঙে গেছে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মারুফুর রশিদ খান জানান, কয়েক দিনের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার করে দিতে পাউবো কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, পেকুয়ায় পাউবোর বেড়িবাঁধ রয়েছে ১১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৭ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ এবং আরও ৫৫ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক বিলীন হয়েছে।

নোয়াখালী: জেলার সেনবাগ, সদর পূর্বাঞ্চল ও কবিরহাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গতকাল গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ রাস্তাঘাট পানির নিচে। অনেক বাড়ির আঙিনায় হাঁটুপানি।

তেল-গ্যাস, বন্দর-বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির জেলা শাখার আহ্বায়ক আ ন ম জাহের উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালীতে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাকে প্রশাসনের বন্যা না বলে জলাবদ্ধতা বলা খুবই দুঃখজনক। এটা প্রশাসন নিজেদের দায় এড়ানোর জন্যই করছে।

ফেনী: সাত দিন পর  ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। দাগনভূঞায় নয়টি ও ফেনী সদর উপজেলায় একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এক হাজার পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। প্রায় ২০০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ও ৮০ কিলোমিটার পাকা সড়কের ক্ষতি হয়েছে।

দাগনভূঞা উপজেলা (ইউপি) পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল কবির জানান, উপজেলার ১১০টি গ্রামের মধ্যে ৭৩টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে রয়েছে। তবে ৩০টি গ্রাম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

মহেশখালী: জোয়ারের পানি প্লাবিত হয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে গতকাল দেড় শ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। দক্ষিণ রাজঘাট এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন ও আব্দুল আলিম বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় লোকালয়ে জোয়ারের পানি কমছে না।

মাতারবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম ছমি উদ্দিন বলেন, জরুরি ভিত্তিতে রাঙাখালী, রোস্তমদোনা ও টিয়াকাটি এলাকার ভাঙা বাঁধ সংস্কার না করলে পাঁচটি গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তিনি এই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসন করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।

মাতারবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, মাতারবাড়ীর পূর্ব পাশে ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে লোকালয়ে জোয়ারের পানি কমছে না। আর দিন-রাত জোয়ারের পানিতে ভাসছে এই এলাকার দুই হাজার ঘরবাড়ি।

জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের বলেন, গতকালও জোয়ারের কবলে পড়ে বেশ কয়েকটি কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভাঙা বাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে।

সাতকানিয়া: উপজেলার বিভিন্ন এলাকা নয় দিন ধরে বন্যার পানিতে ডুবে আছে। সাতকানিয়া-বাঁশখালী সড়কসহ গ্রামীণ অনেক সড়ক এখনো তিন ফুট পানির নিচে। পানিতে তলিয়ে গেছে সবজিখেত ও আমন বীজতলা।

সাতকানিয়া পৌরসভার ছিটুয়াপাড়ার কাউন্সিলর আবদুল মালেক বলেন, সাতকানিয়া-বাঁশখালী সড়কের আনু ফকিরের দোকান ও চরপাড়া পানিতে ডুবে থাকায় সাতকানিয়া সদরে যেতে লোকজনকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। 

কেঁওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, নয় দিন ধরে কেঁওচিয়ার গ্রামীণ সড়কগুলো পানিতে ডুবে আছে। আড়াই হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খাজানূর রহমান জানান, পানিতে ডুবে থাকায় ৫২০ হেক্টর আমন বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, উপজেলার ৪০ ভাগ এলাকা থেকে এখনো বন্যার পানি সরে যায়নি।

আনোয়ারা: চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বারখাইন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নিজাম উদ্দিন বলেন, এলাকায় জোয়ারের কারণে দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। আনোয়ারার ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি, তাই ১৫ হাজার পরিবারের অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।

আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, প্রশাসন দুর্গত মানুষের পাশে রয়েছে।

পটিয়া: চট্টগ্রামের পটিয়ায় উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের মধ্যে কাশিয়াইশ, আশিয়া, শোভনদণ্ডি, ছনহরা, ভাটিখাইন, বরলিয়া, কোলাগাঁও, হাবিলাস দ্বীপ, জুলধা, জিরি, শিকলবাহা ইউনিয়নসহ ১২টি ইউনিয়নে নতুন করে পানি বেড়েছে। পটিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল হোসেন জানান, এসব ইউনিয়নের ৬৭ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে।

হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জ: অস্বাভাবিক জোয়ারে নোয়াখালীর হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন গতকাল রোববার দুপুরে আবারও প্লাবিত হয়েছে।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মো. মঈন উদ্দিন জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে গতকাল উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আশাফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছোট ফেনী নদী ও বমনী নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে উপজেলার মুছাপুর, চর ফকিরা ও চর এলাহী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

চকরিয়া: বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বন্যার্ত লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।

কোনাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার জানান, এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে তাঁর ইউনিয়নের অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। গতকাল দুপুরে চিরিংগা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শনে যান চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাংসদ মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চিরিংগা ইউনিয়নের। এই ইউনিয়নের শতভাগ চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানান, পানি কমতে শুরু করায় অনেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক অফিস প্রতিনিধিরা।