বন্দরে পণ্যের চালানে নজরদারি বেড়েছে

গত ৮ জুলাই পুনরায় পরীক্ষার জন্য বন্দরে জব্দ করা সূর্যমুখী তেলের ড্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা l ফাইল ছবি
গত ৮ জুলাই পুনরায় পরীক্ষার জন্য বন্দরে জব্দ করা সূর্যমুখী তেলের ড্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা l ফাইল ছবি

কোকেন উৎপাদনকারী শীর্ষ তিনটি দেশ বলিভিয়া, কলম্বিয়া ও পেরু থেকে গত দেড় বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে বিভিন্ন পণ্যের ১০৪টি চালান। চালানগুলো খালাসও হয়েছে। এসব দেশ থেকে আসা চালানে এত দিন বিশেষ কোনো নজরদারি না থাকলেও বলিভিয়া থেকে আনা একটি চালানে কোকেন শনাক্ত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছেন কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষও এখন সন্দেহভাজন এসব দেশ থেকে আসা পণ্য চালানে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
বলিভিয়া থেকে বন্দর দিয়ে আনা সূর্যমুখী তেলের একটি চালান পরীক্ষা করে কোকেনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। এ ঘটনায় বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় গত রোববার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ ফরিদ আলম সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত ও আলামত যথাযথভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেন পুলিশকে। বন্দরে শনাক্ত হওয়া কোকেনের এটি প্রথম চালান।
প্রসঙ্গত, কোকেন সন্দেহে গত ৬ জুন রাতে বন্দরে একটি কনটেইনার সিলগালা করা হয়। ৮ জুন এটি খুলে ১০৭টি ড্রামের প্রতিটিতে ১৮৫ কেজি করে সূর্যমুখী তেল পাওয়া যায়। এই তেলের নমুনা প্রাথমিক পরীক্ষা করে কোকেন শনাক্ত না হওয়ায় অধিকতর পরীক্ষার জন্য সবকটি নমুনা ঢাকার দুটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনে কোকেন শনাক্ত হয় বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তথ্য প্রকাশ করে। কনটেইনারটি সিলগালা করার এক মাস আগে জাহাজ থেকে বন্দরে নামানো হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, কোকেন উৎপাদনকারী শীর্ষ তিনটি দেশ থেকে গত দেড় বছরে ৩৯টি প্রতিষ্ঠান ১০৪টি চালান আমদানি করে। এর মধ্যে বলিভিয়া থেকে গত দেড় বছরে আনা হয়েছে তিনটি চালান। কলম্বিয়া থেকে ১৭টি ও পেরু থেকে আনা হয় ৮৪টি চালান। এসব চালানের মধ্যে রয়েছে সাদা দানাদার সাইট্রিক অ্যাসিড, বরিক অ্যাসিড, জিঙ্ক ইনগট, রোটেনান পাউডার, কাপড়, কফি, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি।
জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, নজরদারির কারণে সূর্যমুখী তেলের চালানে কোকেন শনাক্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত আমদানিকারকেরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং একই সঙ্গে অবৈধ পণ্যও যাতে কেউ পাচার করতে না পারেন—এ দুটো বিষয় খেয়াল রাখা হচ্ছে। শনাক্ত হওয়া চালানটি ছাড়া এসব দেশ থেকে সূর্যমুখী তেলের আর কোনো চালান আসেনি।
তিনি বলেন, ‘কোকেন উৎপাদনকারী এসব দেশ থেকে আসা চালানগুলো কঠোরভাবে পরীক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো। এখন আমরাও কঠোর নজরদারি করছি।’
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ প্রতিরোধ–বিষয়ক সংগঠন ইউএনওডিসির ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট ২০১৫–এর তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে কোকেন চাষ হয়। পেরুতে ৬০ হাজার ৪০০ হেক্টর ও কলম্বিয়াতে চাষ হয় ৮৯ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে।
ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কোকেন জব্দ হওয়ার তালিকা অনুযায়ী সমুদ্রপথে কোকেনের চোরাচালান হয়েছে বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ চোরাচালান হয়েছে আকাশ, স্থল ও রেলপথে। বড় চালান পরিবহনের সুযোগ থাকায় সমুদ্রপথে কোকেনের চোরাচালান বেশি হয়।
জানতে চাইলে কাস্টমসের কমিশনার হোসেন আহমদ প্রথম আলোকে জানান, ‘এসব দেশ থেকে যেসব চালান আমদানি হয়, সেসব চালানে এখন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কাস্টমসে ‘পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট’ নামে একটি বিভাগ আছে। ওই বিভাগ থেকেও মাদকদ্রব্যসহ বিপজ্জনক পণ্য আমদানি হচ্ছে কি-না তা তদারকি করা হচ্ছে।’
কাস্টমস সূত্র জানায়, ইউএনওডিসি ও ওয়ার্ল্ড কাস্টম অর্গানাইজেশনের যৌথ উদ্যোগে ‘কনটেইনার কন্ট্রোল প্রোগ্রামের’ আওতায় গত মে মাস থেকে কাস্টম হাউসে ‘পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট’ চালু হয়। এই ইউনিট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক পণ্য চোরাচালান ও অবৈধ বাণিজ্য প্রতিরোধে কাজ করছে। একজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাসহ মোট সাতজন এই ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এখনো এই ইউনিটের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মাদকদ্রব্য ও বিপজ্জনক পণ্য শনাক্ত করার জন্য যন্ত্রপাতিও নেই এই ইউনিটের কাছে।
পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিটের একজন কর্মকর্তা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, ‘মে মাস থেকে চালু হওয়া এই ইউনিট থেকে তদারকি শুরু হয়েছে। ইউএনওডিসি ও ওয়ার্ল্ড কাস্টম অর্গানাইজেশন থেকে রাসায়নিক ও মাদক শনাক্ত করার যন্ত্র দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এই যন্ত্র পেলে সন্দেহভাজন যেকোনো চালানে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে।’