সাড়ে তিন বছরে ৯৬৮ শিশুহত্যা

.
.

সাড়ে তিন বছরে দেশে ৯৬৮টি শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শিশুহত্যার হার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬১ শতাংশ বেশি ছিল। এ বছর হত্যার পাশাপাশি নৃশংসতাও বেড়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের পাশাপাশি বর্তমানে শিশুহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে নারী, শিশু-সংক্রান্ত মামলাসহ প্রায় ৩০ লাখÿ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ সংখ্যাটিও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২৬৭টি সংগঠনের মোর্চা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৪ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের সাত মাসেই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১৯১ জনে।
বর্তমানে শিশুহত্যার প্রক্রিয়া বীভৎস থেকে বীভৎসতর হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ শহিদ মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের নৃশংস ঘটনার শিকার হচ্ছে মূলত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। নির্যাতনকারীরা হচ্ছে প্রভাবশালী। ঘটনা ঘটছে, মামলা হচ্ছে কিন্তু বিচার যে শেষ হচ্ছে, তার কোনো নজির দেখা যাচ্ছে না। ঘটনা ঘটার পর সরকারের পক্ষ থেকে হচ্ছে, দেখছি বা তদন্তাধীন আছে বললে হবে না।
জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বাইরে হয়তো আরও ঘটনা ঘটছে, যেগুলো জানা যাচ্ছে না। ঘটনাগুলো সবার সামনে তুলে ধরার জন্য প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ দেন।
যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায় তারা মানুষের কাতারে পড়ে না বলে প্রতিমন্ত্রী মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সমাজে এদের সংখ্যা কম। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের ওপর গুরুত্ব দেন প্রতিমন্ত্রী।
বীভৎসতার মাত্রা: সিলেটে নির্যাতন করে হত্যা করা শিশু শেখ মো. সামিউল আলম ওরফে রাজনের (১৪) শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সবজি বিক্রেতা এই কিশোরকে চোর অভিযোগে গত মাসে পেটানোর সময় ভিডিওচিত্র ধারণ করে নির্যাতনকারীরাই। নির্যাতনের একপর্যায়ে মৃত্যু হয় সামিউলের। এ ঘটনার পর এক মাসের ব্যবধানে ঘটে গেছে আরও একাধিক নৃশংস এমন হত্যা।
গত মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে সুটকেসের ভেতর থাকা একটি ছেলেশিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার বুকে ও কপালে ছ্যাঁকার দাগ ছিল। পিঠে ছিল পাঁচ ইঞ্চির মতো গভীর জখম। থুতনিতেও জখমের চিহ্ন ছিল। শিশুটির বয়স আনুমানিক নয় বছর। গতকাল পর্যন্ত শিশুর লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গেই পড়ে ছিল।
খুলনায় নির্যাতনের শিকার হওয়া ১২ বছর বয়সী রাকিব গ্যারেজ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এ কারণে আগের গ্যারেজ মালিক ও তার সহযোগী রাকিবকে ধরে মোটরসাইকেলের চাকায় হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসর মেশিনের নল ঢুকিয়ে দেয় তার মলদ্বার দিয়ে। এরপর চালু করে দেওয়া হয় কমপ্রেসর। নল দিয়ে পেটে বাতাস ঢুকে শিশুটির দেহ ফুলে প্রায় বড়দের মতো হয়ে যায়। ছিঁড়ে যায় নাড়িভুঁড়ি, ফেটে যায় ফুসফুসও। মৃত্যু হয় রাকিবের।
বরগুনায় রবিউল আউয়াল নামে ১১ বছরের এক শিশুকে চোখে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। মাছ চুরির ‘অপবাদে’ স্থানীয় এক ব্যক্তি এই বীভৎস কায়দায় তাকে হত্যা করেছে বলে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।
আর মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় মা ও তাঁর পেটের শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা তো দেশজুড়েই আলোচিত।
শিশু নির্যাতন ও হত্যার কটি মামলা আছে, কটি তদন্তাধীন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ ধরনের তথ্য চাওয়া হলে পুলিশ সদর দপ্তর কম সময়ের মধ্যে তা সরবরাহ করতে পারেনি।
তবে চলতি সপ্তাহে আইন কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী ও শিশু-সংক্রান্ত মামলাসহ প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ সংখ্যাটি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচার-প্রক্রিয়ার শ্লথ গতিতে অপরাধীরা অপরাধ করা থেকে নিরুৎসাহিত তো হয়ই না, বরং উৎসাহিত হয়। একজনের বেলায় মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করা হলেও অন্য ১০০ জন লোক তা দেখে ভয় পায়। অপরাধীরা ভেবেই নিচ্ছে—অন্যায় করলে বিচার আর কী? আর বর্তমানে যে ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।’
জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশু নির্যাতনকারীরা সমাজের আর দশটা অপরাধীর মতো নয়। কোনো সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী দল ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে না। অন্য চিহ্নিত অপরাধীদের যেভাবে নিরীক্ষণ করা হয়, এসব ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত পুলিশ তাদের নিরীক্ষণ করতে পারছে না। অপরাধ ঘটার সময় কেউ খবর দিলে পুলিশ শিশুকে রক্ষা করাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
শিশুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মধ্যে হত্যার পরেই ধর্ষণের পরিসংখ্যান নিয়ে সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ৬৩ জন শিশু যৌন হয়রানি এবং ৩২২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর সমন্বিত সেবাকেন্দ্র) সমন্বয়কারী বিলকিস বেগম বলেন, ‘এক বছর বয়সী শিশুকে পর্যন্ত ধর্ষণ করা হয়। আমাদের কাছে যখন ওই শিশুকে আনা হয় তখন তার প্রজনন অঙ্গ একেবারে ছিঁড়ে গেছে। এক, দুই বছর বয়সী কম থাকলেও তিন, চার বা পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।’
সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিনিয়ত শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সামাজিক ন্যায়বিচারহীনতা এবং ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের শক্তি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে দুর্বৃত্তপরায়ণ ও পশু প্রবৃত্তির লোকের প্রাধান্য থাকায় এ ধরনের অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মনেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই গণমাধ্যমকে সচেতনভাবে শিশু নির্যাতনসহ নৃশংস ঘটনাগুলো তুলে ধরার পরামর্শ দেন তিনি।

শিশুহত্যা
২০১২ সালে ২০৯
২০১৩ সালে ২১৮
২০১৪ সালে ৩৫০
২০১৫ সালে ১৯১
(জুলাই পর্যন্ত)