গণপরিবহনে নারীর দুর্ভোগের শেষ নেই

.
.

ঢাকাসহ সারা দেশে গণপরিবহনে যাতায়াত নারীদের জন্য দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ঢাকায় নারীদের জন্য বাস-মিনিবাসে আসন সংরক্ষণের শর্ত থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। ঢাকার বাইরে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
ঢাকায় সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি দুই-একটি মহিলা বাস নামালেও তা দেখা যায় কেবল সকালে-বিকেলে। গণপরিবহনে এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বিকল্প বাহনে যাতায়াত করায় নারীর আয়ের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে পথ খরচায়।
২০০৮ সালে ঢাকার বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণের শর্ত দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটি (ঢাকা মেট্রো আরটিসি)। কিন্তু গতকাল সোমবার রাজধানীতে সরেজমিনে বেশ কয়েকটি বাস-মিনিবাসে উঠে এ ধরনের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। কয়েকটি বাসে ‘মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’ লেখা থাকতে দেখা গেছে। তবে সেখানে নারী নয়, স্থান হয়েছে পুরুষ যাত্রীদের। বিআরটিসির বাসেও নারী আসনে পুরুষ বহনের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকায় চলাচল করা মিনিবাসগুলোতে অলিখিতভাবে চালকের বাঁ পাশের লম্বা আসন নারীদের জন্য বরাদ্দ। সেখানে চারজনের আসনে গাদাগাদি করে বসানো হয় পাঁচজন। নারীদের সংখ্যা আরও বেশি হলে তাঁদের স্থান হয় ইঞ্জিনের ওপর তপ্ত বনেটে। কয়েকজন নারী যাত্রী রসিকতার সুরে বললেন, বাসায় রান্নাঘরের চুলার গরম। আর বাসেও নারীদের জন্য ইঞ্জিনের ওপর তপ্ত আসন বরাদ্দ। অথচ রুট পারমিটে শর্ত হিসেবে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে বলা হয়েছে চালকের পেছনে। ‘সিটিং সার্ভিস’ নামের বাস-মিনিবাসে কখনো কখনো ওই লম্বা আসনেও পুরুষ যাত্রী বসেন।
চালকের আসনের পেছনেও আছে আরেকটি লম্বা আসন। সেখানে বেশির ভাগ সময়ই বসেন পুরুষেরা। ফলে তাঁদের ডিঙিয়ে নারীদের ওঠানামা করতে হয়। আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকায়ও আছে বিপত্তি, অস্বস্তি। ওঠানামার সময় হেলপার-কন্ডাক্টরের অসদাচরণ তো আছেই।
গতকাল সকাল সাড়ে নয়টা। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস এসে থামার আগেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। বাসটি এসেছে সাভারের জিরানী থেকে, যাত্রী ঠাসা হয়ে। ফলে থামার আগেই এই হুড়োহুড়ি। চলন্ত অবস্থায়ও কয়েকজন লাফিয়ে বাসে উঠলেন। অনেক কষ্টে উঠে দরজায় ঠাঁই হয় সাবিনা আক্তার ও তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ের। বিআরটিসির এই বাসটির নিচতলায় চালকের আসনের ঠিক পেছনেই মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি আসন সংরক্ষণের কথা লেখা ছিল। কিন্তু অন্তত পাঁচটি আসনে পুরুষদের বসে থাকতে দেখা গেল।
সাবিনা বেগম বাস থেকে নেমে যান আসাদগেটে। এ সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিনই সকালে এই পথে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসেন। নারীদের জন্য আলাদা আসন সংরক্ষণ দূরে থাক, ওঠারই সুযোগ পান না। এই পথে রিকশাও চলে না। অটোরিকশা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি বলেন, ‘এভাবে যুদ্ধ করে বাসে চড়তে গিয়ে প্রায়ই অস্বস্তি লাগে, হয়রানিরও শিকার হতে হয়। কাউকে বলাও যায় না। মেনে নেওয়াও কঠিন।’
বিআরটিসির ওই বাসটির চালকের সহকারী মনির হোসেনের কাছে নারী আসন দখল করে পুরুষের বসে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘মামা, আমরা চিল্লাইলেও কাম হয় না। অনেক বেডারা মারতে আহে। এহন বলতে ইচ্ছা করে না।’
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশে অনুমোদিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছয় হাজারেরও কম। যানজটের কারণে এগুলোরও পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে গণপরিবহন কোনো চাহিদাই পূরণ করতে পারছে না। আর নারীদের জন্য তো সারা দেশের গণপরিবহনে রীতিমতো দুর্বিষহ অবস্থা। তিনি বলেন, গত শুক্রবার তাঁর সামনেই একটি মিনিবাস এক নারীকে শান্তিনগরে না নামিয়ে কাকরাইলে নিয়ে আসে। সেখানে মিনিবাসটি পুরো থামার আগেই হেলপার ওই নারীকে ঠেলে নামিয়ে দেয়। এতে তিনি সড়কে পড়ে যান।
কাগজে-কলমে নারীদের জন্য ঢাকায় বিআরটিসির ১২টি বিশেষ বাস আছে। কিন্তু বাস্তবে সকাল-বিকেল দুবার দুই-একটি পথে এই বাস চোখে পড়ে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, কোনো পথে যাত্রী কমে গেলে একটি-দুটি বাস মহিলা সার্ভিস হিসেবে নামিয়ে দেওয়া হয়। অন্য পথে চাহিদা বেড়ে গেলে তা আবার তুলে নেওয়া হয়।
বিআরটিসি মহিলা সার্ভিস পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম চালু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এই সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
জানতে চাইলে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মহিলা বাস অধিকাংশই খালি থাকে। ফলে এটি লোকসানি সেবা। এরপরও চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, নারীরা বেশির ভাগই স্বামী কিংবা বাবার সঙ্গে চলাফেরা করেন। এ জন্য মহিলা বাসে যাত্রী পাওয়া যায় না।
সংরক্ষিত নারী আসনে পুরুষ বসে থাকার বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এতগুলো আসন তো সব সময় ফাঁকা রাখা যাবে না। ফাঁকা থাকলে পুরুষ বসে। নারী বা প্রতিবন্ধী যাত্রী এলে উঠে যায়।’
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৩ সালে ঢাকার নারী পোশাককর্মীদের জীবনমান ও হাঁটার বিষয়ে একটি গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক অসচ্ছলতা ও পরিবহনস্বল্পতার কারণে বেশির ভাগ নারী পোশাককর্মী হেঁটে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন।
নীতি আছে কাগজে-কলমে: ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা গোলাম কাদের গণপরিবহনে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা যায় কি না, তা যাচাইয়ের নির্দেশ দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটির বৈঠকে নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে।
ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সংরক্ষিত আসনগুলো হবে চালকের পেছনে, চালকের পাশের লম্বা আসন কিংবা দরজার পাশে নয়। এটাকে চলাচলের অনুমতির (রুট পারমিট) অন্যতম শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই সিদ্ধান্তের পর বিআরটিএ প্রতিটি বাসের রুট পারমিটের দলিলে ‘মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ড্রাইভারের পেছনে নয়টি আসন সংরক্ষণ করুন’ লিখে সিল মেরে দেওয়া শুরু করে। একইভাবে মিনিবাসেও ছয়টি আসন সংরক্ষণের এমন সিল দেওয়া হয়।
রুট পারমিটের শর্ত ভাঙলে চলাচলের অনুমতি বাতিল করার এখতিয়ার আছে পরিবহন কমিটির। কিন্তু ২০০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী আসন সংরক্ষণ না করার কারণে কোনো বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি বাতিলের নজির নেই।
নারীর যাতায়াতে বাড়তি ব্যয়: উম্মে হাবিবা একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। পাশাপাশি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন। তাঁর অফিস গুলশান লিংক রোডে। বিশ্ববিদ্যালয় আফতাবনগরে। আর থাকেন মিরপুরে।
উম্মে হাবিবা বলেন, প্রথমে তিনি বাস-মিনিবাসে অফিস করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তা নিত্যদিনের যাতায়াতের বাহন হিসেবে বেছে নিতে পারেননি। কারণ, অফিস সময়ে বাস-মিনিবাসে পা দেওয়ার জায়গা থাকে না। চালকের সহকারীর ‘মহিলা উঠবেন না’ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আর উঠতে পারলেও নামার সময় অনেকটা গা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এ জন্য অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য কয়েকজন মিলে গাড়ি ঠিক করেছেন। মাসে দিতে হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকা। আর ক্লাসে আসা-যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় দৈনিক গড়ে খরচ ৫০০ টাকা। আয়ের একটা বড় অংশই পথ খরচে চলে যায় তাঁর।
হাবিবার মতো যাতায়াতে এমন বাড়তি খরচ গুনতে হয় অসংখ্য কর্মজীবী নারীকে।