কারাগারে সাংবাদিক প্রবীর সিকদার

সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গতকাল ফরিদপুরের আদালতে হাজির করা হয় l ছবি: প্রথম আলো
সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গতকাল ফরিদপুরের আদালতে হাজির করা হয় l ছবি: প্রথম আলো

একাত্তরের শহীদ পরিবারের সন্তান ও সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গতকাল সোমবার ফরিদপুর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। সেখানে আদালতে তাঁর পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে রোববার সন্ধ্যায় প্রবীর সিকদারকে তাঁর রাজধানীর ইন্দিরা রোডের অনলাইন পত্রিকা অফিস থেকে আটক করে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। এরপর পুলিশ তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। রাত ১২টার দিকে তাঁকে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সদর থানায় তাঁর নামে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা হয়েছে।
প্রবীর সিকদারের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চ এবং বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে প্রতিবাদের ঝড়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রবীর সিকদারের বাবাসহ তাঁর পরিবারের ১৪ জনকে হত্যা করে। ২০০১ সালে জনকণ্ঠ পত্রিকার ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকাকালে রাজাকারদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখার পর সন্ত্রাসীদের হামলায় তাঁকে একটি পা হারাতে হয়। বর্তমানে তিনি দৈনিক বাংলা ৭১, উত্তরাধিকার-৭১ নিউজ অনলাইন পত্রিকা ও উত্তরাধিকার নামের এক ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক।
ফরিদপুর থেকে প্রতিনিধি জানান, রোববার রাতে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় তাঁর নামে মামলা দায়ের করেন জেলা জজ আদালতের সহকারী সরকারি কেঁৗসুলি স্বপন পাল। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে প্রবীর সিকদারকে জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে সোপর্দ করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার পুলিশ এবং ১০ দিনের রিমান্ড চায়। বিচারিক হাকিম মো. হামিদুল ইসলাম তাঁকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন।
ফরিদপুর জেলা বারের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, বারের কোনো আইনজীবী সংক্ষুব্ধ হয়ে কারও বিরুদ্ধে মামলা করলে বারের অন্য কোনো সদস্য ওই মামলার আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন না। যে কারণে প্রবীর সিকদারের পক্ষে ফরিদপুর বারের কোনো আইনজীবী দাঁড়াবেন না।

মামলার আরজিতে বাদী বলেন, প্রবীর সিকদার গত ১০ আগস্ট বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। যার শিরোনাম ছিল ‘আমার জীবনের শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’। শিরোনামের নিচে তাঁর মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী থাকবেন—এমন তিনজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। এঁদের মধ্যে এক নম্বরে আছেন মাননীয় এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নাম। স্ট্যাটাসটি পড়ে আমার দৃঢ়বিশ্বাস হয় যে, প্রবীর সিকদার ইচ্ছাকৃতভাবে গণমানুষের প্রিয় নেতা মোশাররফ হোসেন সম্পর্কে অসত্য লেখা লিখে মাননীয় মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। লেখাটি জনসমক্ষে প্রকাশের মাধ্যমে উসকানি প্রদান করে শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে মাননীয় মন্ত্রীকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এতে মাননীয় মন্ত্রীর মানহানি ঘটেছে। যা একটি ফৌজদারি অপরাধ।

সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের মানববন্ধনে বক্তব্য দেন প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার l ছবি: প্রথম আলো
সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের মানববন্ধনে বক্তব্য দেন প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার l ছবি: প্রথম আলো

প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ জেড এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় মামলা আছে।
প্রবীর সিকদারকে আটকের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সমাবেশে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংবিধানবিরোধী। মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই আইন বাতিল করতে হবে। মত প্রকাশের কারণে প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকার একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া ব্যক্তিদের আটক করে কারাগারে পাঠাচ্ছে। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের উল্টোযাত্রা।
প্রকাশক রবীন আহসান বলেন, ফরিদপুরের আইনজীবীরা প্রবীর সিকদারের পক্ষে আদালতে দাঁড়াবেন না। এর মানে কি ফরিদপুর বাংলাদেশের বাইরের? সেখানে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর নয়?
প্রবীর সিকদারের ছেলে সুপ্রিয় সিকদার বলেন, ‘আমার বাবা একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সে জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন আমার বাবা আসামি। সেই আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারবেন না, এ কেমন রাষ্ট্র?’

সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে গণজাগরণ মঞ্চ l প্রথম আলো
সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে গণজাগরণ মঞ্চ l প্রথম আলো

সুপ্রিয় আরও বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল আহাদ রোববার সন্ধ্যার পর আমাদের বলেছিলেন, “তোমার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের দরকার ছিল। করা হয়েছে। একটু পরে ছেড়ে দেওয়া হবে। তোমার মাকে ডেকে আনো। তিনি আসার পর তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে চলে যেয়ো।” এর কিছুক্ষণ পর তাঁর কাছে একটি ফোন এলে তিনি বলেন, “আজ রাতে তোমার বাবাকে এখানে থাকতে হবে।” আমি বললাম, বাবাকে কি বিছানা দেওয়া হবে? আহাদ সাহেব বললেন, “না, চেয়ারে বসে থাকতে হবে।” তখন আমি বললাম, ধরে নিন, আপনার একটি পা নেই। একটি হাত অকেজো। আপনি কি সারা রাত চেয়ারে বসে থাকতে পারবেন? তখন আহাদ সাহেব বললেন, “বাবা, তুমি আমাকে প্রশ্ন কোরো না। আমার হাত-পা বাঁধা”।’
প্রবীর সিকদারের ছোট ভাই পীযূষ সিকদার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীরা আমার বাবাসহ আমাদের পরিবারের ১৪ জনকে হত্যা করেছে। ২০০১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীরা আমার ভাইয়ের পা কেড়ে নিয়েছে। তাই আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে হচ্ছে, আমার মায়ের কপালে সিঁদুর নেই। আমার ভাইয়ের পা নেই।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতা নাসির উদ্দিন, গণজাগরণ মঞ্চের নেতা সংগীতা ইমাম প্রমুখ। এরপর সংগঠনটি মিছিল বের করে। মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘৫৭ ধারার বাতিল চাই, প্রবীর সিকদারের মুক্তি চাই’।
এর আগে দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ‘বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ’। এ সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রবীর সিকদারকে মুক্তি দেওয়া না হলে দেশব্যাপী সাংবাদিকেরা কঠোর আন্দোলনে নামবেন।
প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীকে সুস্থভাবে ফিরে পেতে চাই।’
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন ইমরান এইচ সরকার, অমিয় ঘটক পুলক, আশীষ কুমার দে, খায়রুজ্জামান কামাল, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের নেতা কামাল পাশা, বাপ্পাদিত্য বসু, অঞ্জন রায় প্রমুখ।
এ ছাড়া প্রবীর সিকদারের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অনলাইন জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলােদশ (ওজাব), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল।