'খান পরিবার' বনাম 'নির্যাতিত আওয়ামী সমর্থক পরিবার'

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগে ‘খান’ আর ‘সিদ্দিকী’ পরিবারের দ্বন্দ্ব-দাপট অনেকটাই মিইয়ে এসেছে। দুই পরিবারের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া আওয়ামী লীগ এখন নতুন পথের সন্ধানে। এই দুই পরিবারের বাইরে থাকা দলের নেতা-কর্মীরা ‘নির্যাতিত আওয়ামী সমর্থক পরিবার’ নামে নতুন একটি বলয় তৈরি করেছেন।
তবে বসে নেই খান পরিবারও। পরিবারের চার ভাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় পলাতক থাকলেও আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে জেলার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। তা যদি না-ও পারেন, তাহলে তাঁদের অনুসারী কাউকে জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কার করার পর তাঁদের অনুসারীরাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ফেরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে। সেই সম্মেলনে শামসুর রহমান খানকে সভাপতি এবং ফজলুর রহমান খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কমিটির সভাপতিসহ ১০ জন নেতা মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে নিষ্ক্রিয় আছেন কয়েকজন। এ অবস্থার মধ্যে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান বলেন, সব সময় রাজনীতিই টিকে থাকবে। অর্থ বা শক্তির নীতি কখনো টিকে থাকে না। তিনি বলেন, সাময়িকভাবে হয়তো কোনো শক্তি রাজনীতিকে গ্রাস করতে চায়, হয়তো সফলও হয়, তবে সেই সফলতা দীর্ঘস্থায়ী নয়। এবার কাউন্সিলের পর টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ দারুণ গতি পাবে বলে তিনি আশা করছেন।
জেলা কমিটিতে যাঁরাই থাকুক না কেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বহুল আলোচিত খান পরিবারের হাতে। শুধু রাজনীতি নয়, জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন—সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এই পরিবার। এ পরিবারের বড় ছেলে আমানুর রহমান খান (রানা) টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। তাঁর ভাই সহিদুর রহমান খান (মুক্তি) দলীয় মনোনয়ন নিয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। আরেক ভাই জাহিদুর রহমান খান (কাকন) বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব নেন। ছোট ভাই সানিয়াত খান (বাপ্পা) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিগত কমিটির সহসভাপতি হন। বর্তমান কমিটিও মেনে নেয় খানদের আধিপত্য। তবে লতিফ সিদ্দিকী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী থাকায় পুলিশ ও প্রশাসনে তাঁর প্রভাব ছিল। ফলে সিদ্দিকীদের সমীহ করেই চলত খানেরা।

জানতে চাইলে খানদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলমগীর খান প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো পরিবারের দল নয়। সামনে কাউন্সিল হবে। সেখানে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। সবাইকে নিয়েই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে।
কিন্তু ২০১৪ সালে জেলার রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যায়। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় গত বছর আগস্টে আনিসুল ইসলাম রাজা ও মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁদের জবানবন্দিতে সাংসদ আমানুর ও তাঁর ভাইদের জড়িত থাকার বিষয়টি বের হয়ে আসে। ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে খান ভাইয়েরা টাঙ্গাইল ত্যাগ করেন। এরপর একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতির চিত্র।
ওই সময় ফারুক হত্যার বিচারের দাবিতে তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদের নেতৃত্বে ‘নির্যাতিত আওয়ামী সমর্থক পরিবার’ ব্যানারে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক মাঠে নামেন। তাঁরা প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি শুরু করেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতা এ আন্দোলনে যুক্ত হন। ৪ আগস্ট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমানও খানদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তিনি খান ভাইদের সমালোচনা করেন।
নাহার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, খুনিরা আওয়ামী লীগ চালাতে পারে না। আওয়ামী লীগকে যাঁরা ভালোবাসেন, নেতৃত্ব গুণ আছে, তাঁরাই দল চালাবেন। জেলার মানুষ খুনিদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখন নেতা-কর্মীরা ভয়ভীতিমুক্ত থেকে রাজনীতি করতে পারবেন।
অন্যদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলমগীর খানসহ অপর অংশটি খানদের পক্ষেই অবস্থান করছেন বলে দলের কর্মীরা জানান। সদর আসনের সাংসদ সানোয়ার হোসেনও খান সমর্থকদের পক্ষে আছেন। বাকি সাংসদেরা অবশ্য খানদের বিরুদ্ধে।
এবারের সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আশরাফুজ্জামান। প্রয়াত ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ এবং আলমগীর খানও প্রার্থী হতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে তাঁরা এ বিষয়ে কিছু বলছেন না।