পছন্দের নেতার জন্য নিয়ম বদল, অসন্তোষ

পছন্দের লোককে পদ দিতে যখন-তখন ‘নিয়ম’ বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগে। এতে নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ এবং সংগঠনে বিভেদ তৈরি হচ্ছে। ‘যোগ্য’ নেতাদের অবমূল্যায়ন সংগঠনকে স্থবির করে তুলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে সাতটি উপজেলায় নয়টি সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। প্রতিটি উপজেলা কমিটির বাইরে পশ্চিম পটিয়ার কর্ণফুলী থানা ও পটিয়া পৌর এলাকার পৃথক কমিটি রয়েছে। এই নয় কমিটির নিয়ন্ত্রণ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের হাতে।
সাংগঠনিক স্থবিরতার কথা স্বীকার করে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘চারটি উপজেলায় আমরা সম্মেলন করেছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি বাকিগুলো করার। সম্মেলন হলে দলের নেতা-কর্মীরা চাঙা থাকেন। দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় সম্মেলন করা যায় না।’
২০১৪ সালে লোহাগাড়া, পটিয়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়। মূলত এই কমিটিগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েই যখন-তখন ‘নিয়ম’ বদলের অভিযোগ উঠেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, লোহাগাড়া উপজেলার সম্মেলনে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক নুরুল আবছার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়, জেলা কমিটিতে থাকা অবস্থায় উপজেলায় নির্বাচন করা যাবে না। সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য মনোনীত হন জেলা কমিটির সভাপতি মোছলেম উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন।
একই কারণ দেখিয়ে জেলা কমিটির সহসভাপতি হাবিবুর রহমানকে চন্দনাইশ উপজেলা কমিটির সভাপতি পদে নির্বাচনে করতে বাধা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। তবে তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। পরে দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য হাবিব একটি মামলা করেছিলেন। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে জাহেদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি জেলার সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, কাজের কোনো দাম নেই। দয়ার সাগরে যাঁরা আছেন, তাঁরা পদ পেয়েছেন। একই কারণে লোহাগাড়ায় নুরুল আবছারকে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। আবার পটিয়ার ক্ষেত্রে পালন করা হলো অন্য নিয়ম।
পটিয়া উপজেলার কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম পাল্টে যায়। ওখানে জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রাশেদ মনোয়ার দিব্যি নির্বাচন করে উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তাঁর বেলায় জেলা কমিটিতে থাকা না-থাকার নিয়ম ধর্তব্যের মধ্যে আসেনি।
জানতে চাইলে জেলা কমিটির সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা কমিটিতে থাকলে থানায় যেতে পারবে না—এমন কোনো নিয়ম নেই। তবে আমরা তখন তাঁদের নিরুৎসাহিত করেছিলাম। পরে পটিয়ার ক্ষেত্রে আর বাধা দিইনি। ওখানে যুগ্ম সম্পাদক রাশেদ মনোয়ারকে জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করার পর উপজেলা কমিটিতে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়।
আর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, পটিয়া গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা বলে রাশেদ মনোয়ারের বিষয়টা মেনে নেওয়া হয়।
আবার সাতকানিয়ায় সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন জেলা কমিটির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান। ওই পদে অপর প্রার্থী ছিলেন এম এ মোতালেব। মোতালেবকে সভাপতি করার জন্য মিনহাজুর রহমানকে জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করার আশ্বাস দেওয়া হয়। আশ্বাস পেয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক সম্বোধন করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।’
সম্মেলনের আগে ৫ জুন মিনহাজুর রহমানকে দক্ষিণ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক সম্বোধন করে পরবর্তী সভায় উপস্থিত থাকার জন্য একটি চিঠিও দেওয়া হয়। তাতে সই করেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। ওই সভায় এটি পাস করার কথা ছিল।
চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করে সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা তাঁকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে একটি চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে বর্ধিত সভায় ওটা অনুমোদনের কথা ছিল। ওই সভা হয়নি। পরে একটি সভা হলেও কমিটির বাকি সদস্যরা এটা মেনে নেননি। তাই তাঁকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।’
তবে সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সম্বোধন করে চিঠি দেওয়া হয়নি। উনি নিজে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
বাঁশখালী উপজেলা কমিটি করা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯ বছর ধরে সভাপতি পদ আগলে রেখেছেন বর্তমান সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর। গত উপজেলা নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। চেয়ারম্যান ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয় জামায়াতে ইসলামী।
বোয়ালখালীতে সম্মেলন হয়েছে ১৫ বছর আগে। জেলা কমিটির সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও সহসভাপতি আবুল কালামের উপজেলা এটি। কিন্তু এই দুই ব্যক্তির অনুসারীদের কোন্দলের কারণে এখানে দীর্ঘদিন সম্মেলন হচ্ছে না বলে নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন।
আনোয়ারা থানা ও কর্ণফুলী থানা আওয়ামী লীগ চলছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর তিন মাসের জন্য এই দুটি কমিটি করা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ কমিটি আর হয়নি। আনোয়ারায় অ্যাডহক কমিটিতে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদককেই রাখা হয়। অ্যাডহক কমিটি করার পর আনোয়ারায় অন্তঃকোন্দল বেড়েছে। সেখানে একাধিকবার মারামারির ঘটনাও ঘটে।
জানতে চাইলে সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চারটি উপজেলায় সম্মেলন করতে পারিনি। বাঁশখালীতে সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এটা হয়ে যাবে।’