বেতফল

বেতফল l ছবি: লেখক
বেতফল l ছবি: লেখক

‘আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;
বলেছিল: এ নদীর জল
তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল’
—জীবনানন্দ দাশ
বাংলার মাটির গুণে এখানে হাজারো তরুলতার সমাহার। নদীবাহিত পলি, বৃষ্টিপাত আমাদের দেশকে দিয়েছে এক উর্বর ভূমি। দেশে রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি প্রজাতির বন্য গাছপালা। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক বন্য গাছগাছড়াই এখন বিলুপ্তির পথে।
আবার ভিনদেশি গাছের আগ্রাসনেও হারিয়ে যেতে বসেছে বুনো প্রজাতি। আমাদের নিজস্ব গাছপালা নিয়ে তেমন গবেষণা হচ্ছে না। বরং ভিনদেশের ফলের গাছ, কাঠের গাছ ও ফুলের গাছ রোপণ এবং চাষের জন্য শহর, গ্রামের মেঠোপথ ও প্রাকৃতিক বন ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক মহল ও ব্যক্তি বিদেশি ফল-সবজির চাষাবাদে মানুষকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। এতে দেশীয় গাছপালার ওপর মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে।
অথচ আমাদের কবিরাজ, আদিবাসী, গ্রামীণ লোকজন এখনো নানা ওষুধ ও ফলের জন্য দেশীয় গাছপালার ওপরই নির্ভরশীল। আমাদের সব কবিই আমাদের দেশের প্রকৃতি ও গাছপালার জয়গান করেছেন।
বেতফল আমাদের ছোটবেলার এক অতি কাঙ্ক্ষিত ফল। আমরা সহজেই যাকে পেতাম না। আমরা ছেলেবেলায় একে বলতাম বেতুইন ফল। ফল পরিপক্ব হলেই বেতঝাড়ে হানা দিতাম সাবধানে। তারপরও পায়ে, জামা-কাপড়ে বেতের কাঁটা যেত বিঁধে। ফলের বাইরের খোলস ফেলে যখন রসাল অংশটা হাতে আসত, তখন সে আনন্দ গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করত। গ্রামে বেতের ঝাড় খুবই কম দেখা যেত।
বেত কাঁটাময়, চিরসবুজ, অরোহী পাম। কাণ্ড লম্বা, কাঁটাযুক্ত ও শাখাহীন। সরু ও নলাকার কাণ্ড প্রস্থে সাধারণত ৫-১৫ মিলিমিটার। প্রতিটি কাণ্ডের আগা থেকে নতুন পাতা বের হয় ও বেড়ে ওঠে। কাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর নিচের অংশ পোক্ত হতে থাকে। কোনো ধারককে ধরে রাখার জন্য কাঁটাযুক্ত ধারক লতা বের হয়। বেতে ফুল ধরার আগে গাছ থেকে একধরনের মিষ্টি ঘ্রাণ আসে। তখন মৌমাছি, পিঁপড়া, মাছি আসে সেই রস খেয়ে মাতাল হওয়ার জন্য।
সাধারণত গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আর্দ্র জায়গায় বেতগাছ জন্মে। কিছুদিনের মধ্যেই বেত ঘন হয়ে ঝাড়েও পরিণত হয়। এ প্রজাতি বাংলাদেশের সর্বত্র জন্মে। Arecaceae পরিবারের এ প্রজাতির বেতের বৈজ্ঞানিক নাম calamus tenuis। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও হাওরের কান্দাতে বেতগাছ জন্মে। সারী নদীর তীরের শালুটিগড় হাওর, সুরমা নদীর তীরের জিলকার হাওর ও পাথরচাউলি হাওরের কান্দায় এ বেতের ঝোপ দেখেছি। এটির আদি আবাস হিমালয়ের উষ্ণ এলাকা, বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার।
বেত অতি মূল্যবান ও অর্থকরী উদ্ভিদ। উন্নতমানের হ্যান্ডিক্রাফট, গৃহের আসবাবপত্র তৈরির জন্য বেতের ব্যবহার বেশি। কস স্বাদযুক্ত ফল গ্রামীণ শিশুদের অতি প্রিয়। এ ফল বাজারে বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেতের কচি কাণ্ড তরকারি হিসেবেও খাওয়া হয়।