দুজনের চার বছর করে কারাদণ্ড

শেয়ারবাজারের ১৯৯৬ সালের বহুল আলোচিত কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিক টেক্সের বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযুক্ত দুজনকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের ৩০ লাখ টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট মামলা নিষ্পত্তির জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হুমায়ুন কবির গতকাল সোমবার এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে আসামিদের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানার অর্থ ঘটনার সময় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যয় করতে পারবে।
চিক টেক্সের শেয়ার কারসাজি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দুজন হলেন কোম্পানির পরিচালক মাসুকুর রসুল ও ইফতেখার মোহাম্মদ। সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামি পলাতক। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, আসামিদের গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের দিন থেকে সাজা কার্যকর হবে। তবে বাদীপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা জানিয়েছেন, আসামিরা চাইলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন।
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত দুজনই দেশের বাইরে রয়েছেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কার্যক্রমের শুরু থেকে আসামিদের কোনো আইনজীবীও আদালতে ছিলেন না। এ অবস্থায় গত ২৮ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত জুনে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর এটি তৃতীয় রায়। আগের রায় দুটি শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত আলাদা দুটি মামলায় হলেও গতকালেরটি ছিল ’৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির প্রথম রায়। ’৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে মোট ১৫টি মামলা করা হয়েছিল।
বিএসইসির আইনজীবী মাসুদ রানা জানিয়েছেন, ’৯৬ সালের আলোচিত শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ১৫ মামলার মধ্যে তিনটি মামলা বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আসে। তার মধ্য থেকে একটির রায় ঘোষণা হলো, অপর দুটির বিচার কার্যক্রম চলছে।
চিক টেক্স কোম্পানিটি বর্তমানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিকল্প ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) বাজারে তালিকাভুক্ত। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালে জানুয়ারিতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এটি একটি অস্তিত্বহীন কোম্পানি। ২০০৩-০৪ সালের পর থেকে এ কোম্পানি-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই ডিএসইর কাছে নেই। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় ২০০৯ সালে এটিকে মূল বাজার থেকে ওটিসি বাজারে স্থানান্তর করা হয়।
চিক টেক্সের মামলার অভিযোগে বলা হয়, মাসুকুর রসুল কোম্পানিটির ৮ লাখ ২৮ হাজার এবং ইফতেখার মোহাম্মদ ৮ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ারের মালিক ছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে এ দুজন মিলে নানা প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ান। পরবর্তী সময়ে কোনো ঘোষণা ছাড়াই সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে দুজনই তাঁদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেন। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করতে হলে তা ঘোষণা দিয়ে বিক্রি করতে হয়।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন ধরনের কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। এর ফলে ডিএসইর সূচক বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ওই বছরের ৫ নভেম্বর প্রধান সূচকটি বেড়ে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৪৯ পয়েন্টে উঠে যায়। সেখান থেকে বাজারের পতন শুরু হয়। এর ফলে কমতে কমতে একপর্যায়ে সূচকটি ৪৬২ পয়েন্টে নেমে আসে। কারসাজির মাধ্যমে সূচকের বড় ধরনের উত্থান ও পতনের ঘটনায় সে সময়কার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন (বর্তমানে সাবেক) উপাচার্য আমীরুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ’৯৭ সালের এপ্রিলে বিএসইসির পক্ষ থেকে কারসাজির অভিযোগে ১৫টি মামলা করা হয়।
বিএসইসির নথি অনুযায়ী, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম বা সিএমএম আদালতে ’৯৭ সালের ৪ মে চিক টেক্সের মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় দুই পরিচালক ছাড়াও কোম্পানিটিকেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি বিচারের জন্য মহানগর দায়রা আদালতে স্থানান্তর হয়। পরে আসামিপক্ষ ওই মামলার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায় এবং সেখান থেকে দুই আসামি জামিনও নেন।
এদিকে, এর আগে ট্রাইব্যুনাল শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট অপর দুই মামলায় তিন অভিযুক্তকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানোর দায়ে মাহবুব সারওয়ার নামে ব্রোকারেজ হাউসের সাবেক এক কর্মকর্তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার নিয়ে কারসাজি-সংক্রান্ত অপর মামলায় কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম নুরুল ইসলাম ও ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত করিমকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।