কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, কমছে শিশুর অপুষ্টি

.
.

গত তিন বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২০টি জেলায় খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা ৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর ক্ষমতা ও কৃষিতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় এই সাফল্য এসেছে। কারণ মায়েরা আগের চেয়ে শিশুদের সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য বেশি দিতে পারছেন।
খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ২০১৫ সালের সর্বশেষ নিজস্ব খানা জরিপের সঙ্গে ২০১১-১২ সালের নিজেদের জরিপের তুলনা করে এই তথ্য পেয়েছে। আর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত এক যুগে দেশের
কৃষির নারীকরণ হয়েছে। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ যত বাড়ছে, পরিবার ও শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির তত উন্নতি হচ্ছে।
ইফপ্রির ওই গবেষণায় দেশের সাতটি বিভাগের নারীর ক্ষমতায়নের একটি সূচক তৈরি করা হয়। মূলত পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ওই ক্ষমতায়নকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতা, আর্থিক উপার্জনের ক্ষমতা, ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা ও সমাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। দেখা গেছে, বরিশাল আর্থিকভাবে দেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এলাকা হলেও ওই বিভাগের ৩০ শতাংশ নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। অথচ সারা দেশে গড় এই হার ২৩ শতাংশ।
ওই জরিপে দেখা গেছে, দেশের আর্থিকভাবে অন্যতম সচ্ছল এলাকা সিলেটে নারীর ক্ষমতায়ন মাত্র ১১ শতাংশ। আর চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ। অথচ আর্থিকভাবে আরেকটি পিছিয়ে পড়া এলাকা খুলনা ও রাজশাহীর নারীরা যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ ক্ষমতায়িত। ঢাকা সবচেয়ে সচ্ছল এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এলাকার গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নের হার ২৭ শতাংশ।
ইফপ্রির জরিপটিতে দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ বাড়িতে মুরগি পালন নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। ছাগল ও গরু পালনে নারীদের নিয়ন্ত্রণ ৫৫ শতাংশ। কুমড়া ও লাউচাষিদের ৪২ শতাংশ ও টমেটোচাষিদের ৩৮ শতাংশ নারী। ধান কাটা ও রোপণের ক্ষেত্রে নারীদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকলেও ধান কাটার পরের ধাপের বেশির ভাগ কাজই নারী করে থাকেন। জরিপ অনুযায়ী ধান মাড়াই, শুকানো, সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণের ৫৮-৭১ শতাংশই নারীর ওপর নির্ভরশীল।
এফপ্রির ‘পুষ্টি ও কৃষিতে নারী’ শীর্ষক আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা তাঁদের আয়ের ৭০ থেকে ৯০ শতাংশই ব্যয় করছেন পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়। আর পুরুষদের এ ক্ষেত্রে ব্যয় মোট আয়ের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।
ইফপ্রির ২০১১-১২ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল, দেশের যেসব এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন বেশি হয়েছে, সেসব এলাকায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা কম। অর্থাৎ, ওই সব এলাকার ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা বেশি পুষ্টিকর খাবার পায় এবং তারা কম খর্বাকৃতির। যেসব পরিবারে নারীরা ক্ষমতাবান, সেসব পরিবারের শিশুরা গড়ের চেয়ে খাবারে দুটি পদ বেশি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলো সারা দিনে ১২টির মতো উপকরণ খায়। যেমন চাল, ডাল, সবজি, লবণ, তেল, মসলা ইত্যাদি।
ইফপ্রি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১১-১২ সালের খানা জরিপের সঙ্গে আমরা আমাদের ২০১৫ সালের জরিপের একটি তুলনা করে দেখেছি যে আগের চেয়ে কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। এতে শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা কমেছে।’
অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন এবং ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক আবদুল বায়েস ১২ বছর ধরে করা তাঁদের এক গবেষণায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে গত এক যুগে বাংলাদেশের ‘কৃষির নারীকরণ’ হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই দেশের কৃষি খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন নারীরা। তাঁদের এই নেতৃত্বের কারণেই দেশের পরিবার ও শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে ওই দুই অর্থনীতিবিদের গবেষণায় দেখা গেছে।