রাস্তায় দ্বিখণ্ডিত ব্রহ্মপুত্র, অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার দুটি ইউনিয়ন জালালপুর ও লোহাজুড়ি। ৩৭ বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদ ইউনিয়ন দুটিকে উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তখন সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে নদে বাঁধ দেন গ্রামবাসী। ফলে কটিয়াদীতে এসে নদটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় অর্থনীতিতে পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র কটিয়াদীতে এসে মূল শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কটিয়াদী অংশে নদটি প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্ত। নদের কারণে বিচ্ছিন্ন দুই ইউনিয়নবাসীকে মূল শহরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করার ভাবনা থেকে ১৯৭৮ সালে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, সদর ইউপির চেয়ারম্যান গোলাপ মিয়া ও মসূয়া ইউপির চেয়ারম্যান আ. রহমান। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে বাঁধের নির্মাণ ব্যয় মেটানো হয়।
ওই তিন চেয়ারম্যানের মধ্যে শুধু গোলাপ মিয়া বেঁচে আছেন। কী প্রেক্ষাপটে তখন নদে বাঁধ নির্মাণ করা হয়—জানতে চাইলে গোলাপ মিয়া বলেন, ‘খেয়া পারাপারের সময় নৌকা ডুবত। ঘর ভাঙত। গাঙ্গের মুখে জমিজিরাতও চলে যাইত। তখন আর কী করা, বান (বাঁধ) দিয়া দিলাম।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, নদটির বর্তমান দুরবস্থার পেছনে তাঁদের আবেগপূর্ণ উদ্যোগটি অনেকাংশে দায়ী।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কটিয়াদী থানা ভবন থেকে জালালপুর ইউনিয়নের চরজাকালিয়া গ্রাম বরাবর বাঁধটি দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই বাঁধের কোথাও পানিপ্রবাহের সুযোগ রাখা হয়নি। একসময়ের কাঁচা বাঁধটি এখন পাকা সড়ক। চলছে ছোট-বড় যান। নদের জায়গা দখলে নিয়ে দুই পাড়ে বহু দোকান ও ভবন গড়ে উঠেছে। বিচ্ছিন্নতার কারণে এই বর্ষা মৌসুমে এক প্রান্তে পানি থাকলেও আরেক প্রান্ত শুকনা থাকে। বাঁধের দুই পাড়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে সড়কটির পরিচয় হিসেবে ‘কটিয়াদী নদী বাঁধ’ লেখা আছে।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, একসময় কটিয়াদীর প্রাণচাঞ্চল্য ছিল ব্রহ্মপুত্রকেন্দ্রিক। ব্রিটিশ আমল থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্যে ভৈরব ও কটিয়াদী ব্যবসাকেন্দ্র ছিল। একই সঙ্গে বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। মেঘনা নদীর কল্যাণে ভৈরব টিকে থাকলেও ব্রহ্মপুত্র মরে যাওয়ায় কটিয়াদী খ্যাতি হারিয়েছে। একই কারণে পাটের মোকাম হিসেবে কটিয়াদীর বিশেষ খ্যাতিও আর নেই। কৃষি, মৎস্যসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কটিয়াদী পাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আশীষ কান্তি সাহা বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র ছিল এই বাজারের অক্সিজেন। ৩৭ বছর আগে আমরা অক্সিজেনের উৎস নষ্ট করেছি। এখন আমাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’
নদ বাঁচাতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। দখল ও একের পর এক স্থাপনা গড়ে উঠলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের মরি মরি অবস্থার জন্য বাঁধটিই দায়ী। বিষয়টি তাঁরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নজরে আনবেন বলে জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা আছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাব বলেন, সড়ক টিকিয়ে রেখে নদটির বিচ্ছিন্নতা দূর করার উপায় খোঁজা হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের সাংসদ সোহরাব উদ্দিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্রের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নৌ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫৪৮ কোটি টাকায় গাজীপুরের টোক থেকে কটিয়াদীর চরমান্দালিয়া পর্যন্ত খননকাজ শুরু করা হয়েছে। দুটি সেতুর মাধ্যমে সড়কটি টিকিয়ে রেখে ব্রহ্মপুত্রকে এক করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখবেন বলেও জানান সাংসদ।