কমলাবুক হরিয়াল

গাছের ডালে এক জোড়া হরিয়াল। সুন্দরবনের আন্ধারমানিক থেকে তোলা ছবি l লেখক
গাছের ডালে এক জোড়া হরিয়াল। সুন্দরবনের আন্ধারমানিক থেকে তোলা ছবি l লেখক

চট্টগ্রামে গেছি একটি সম্মেলনে। কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন ছাত্রসম ডা. মানিকের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর আমন্ত্রণে ওই সাফারি পার্কে গেলাম। পার্কে কুমিরের আবাসস্থলের উল্টো পাশে একটি চমৎকার লেক। পার্কের মনোরম পরিবেশে ঘণ্টা খানেক কাটানোর পর সামনের দিকে এগোতেই নাম না জানা উঁচু গাছের মগডালে একটি পাখি এসে বসল। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে কমলাবুকের পুরুষ পাখিটাকে শনাক্ত করলাম।
দ্বিতীয়বার কমলাবুকের পাখি দেখলাম সুন্দরবনে। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ গত ১৫ মার্চ সুন্দরবনের আন্ধারমানিকের একটি খাল দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটি গাছের বেশ উঁচুতে কমলাবুকের পাখিটির দেখা পেলাম। একা নয়, স্ত্রীসহ। হঠাৎ স্ত্রী পাখিটি উড়াল দিল, মিনিট খানেক পরে পুরুষটিও উড়ল। আর উপহার দিয়ে গেল বেশ কটি উড়ন্ত ছবি। কমলাবুকের এই পাখিটি হলো এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি কমলাবুক হরিয়াল (Orange-breasted Green Pigeon or Orange-breasted Pigeon)। কোলাম্বিডি পরিবারভুক্ত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Treron bicinctus.
হরিয়াল জালালি কবুতরের চেয়ে আকারে কিছুটা ছোট। ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত প্রায় ২৯ সেন্টিমিটার। আর ওজন ১৫৫ থেকে ১৯৪ গ্রাম। পুরুষ ও স্ত্রীর দেহের রঙে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের কপাল হলদে-সবুজ, মাথার চাঁদি থেকে ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নীলচে-ধূসর। পিঠ ও ডানার ওপরটা জলপাই-সবুজ। ডানার কিছু পালকের প্রান্ত হলুদ। উড়লে ডানার পালকের তলার ধূসর রং চোখে পড়ে। পিঠের নিচ ও লেজের সংযোগস্থলের ওপরটা দারুচিনি রঙের। লেজের ওপরটা ধূসর, আগা ফিকে। মুখমণ্ডল হলদে-সবুজ, গলা বেগুনি ও বুক উজ্জ্বল কমলা। পেট হলদে-সবুজ ও লেজের তলা কমলা। স্ত্রী হরিয়ালের দেহের ওপরটা জলপাই-সবুজ ও নিচটা হলদে-সবুজ। মুখমণ্ডল হলদে-সবুজ। লেজের পেটে দারুচিনি ও ধূসরের প্রাধান্য এবং নিচটা হালকা কমলা। স্ত্রী ও পুরুষনির্বিশেষে ঠোঁট নীলচে-সবুজ এবং পা ও পায়ের পাতা গাঢ় গোলাপি। চোখের মণির বাইরের বলয় লালচে ও ভেতরেরটা গাঢ় নীল। অপ্রাপ্তবয়স্কগুলো দেখতে মায়ের মতো।
হরিয়াল মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং খুলনা বিভাগের সুন্দরবনের বাসিন্দা। সাধারণত একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। আবার অন্যান্য সবুজ কবুতরের দলেও একসঙ্গে বিচরণ করতে দেখা যায়। বট, পাকুড়, ডুমুর, পাকা খেজুর, বড়ই ও এ-জাতীয় ছোট ফল পছন্দ করে। ফলে ভরা গাছের উঁচু শাখায় ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে ফল ও বিচি খায়। খুব ভোরে খেজুরের রসও খেতে দেখা যায়। সকাল ও সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয় থাকে। তবে ভরদুপুরেও খাবার খেতে দেখেছি। দ্রুত ডানা নেড়ে বেশ জোরে সোজা পথে ওড়ে। নিচু স্বরে শিস দেওয়ার মতো করে ডাকে।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। এ সময় গাছের ডালে কাঠি-কুটি দিয়ে বাসা বানায়। এদের বাসা ঘুঘুর থেকে কম ঢিলেঢালা, বেশি গভীর ও বাসার কিনারা ওপরের দিকে ওঠানো। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী তাতে দুটো সাদা রঙের ডিম পাড়ে ও দুজনেই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১২ থেকে ১৪ দিনে। বাবা-মা দুজনেই বাচ্চাদের খাইয়েদাইয়ে বড় করে তোলে।