বিপন্ন মুখপোড়া হনুমান

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মুখপোড়া হনুমান l ছবি: লেখক
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মুখপোড়া হনুমান l ছবি: লেখক

৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বনভোজনে গিয়েছিলাম মধুপুর জাতীয় উদ্যানে। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় বনের কিছুটা গহিনে চলে গেলাম। হাঁটছি আর গল্প করছি, কিন্তু নজর আমার গাছের মগডালে। হঠাৎ আমার উৎসুক চোখ আটকে গেল শাল-গজারির মগডালে। আবিষ্কার করলাম তিনটি প্রাণী।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার দেখা ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ সকালে, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে। এরপর লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, আদমপুর বিট ও রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে নিয়মিত দেখা হতে লাগল।
এতক্ষণ যে প্রাণীর কথা বললাম, সে হলো মুখপোড়া হনুমান (Capped Langur, Capped Monkey, Capped Leaf Monkey বা Bonneted Langur)। লালচে হনুমান নামেও পরিচিত। আমাদের মতোই প্রাইমেট বর্গের সদস্য। সাধারণভাবে Langur নামে পরিচিত, যার শাব্দিক অর্থ ‘লম্বা লেজওয়ালা’। মূলত গাছের পাতা খেয়ে জীবনধারণ করে বলে ‘পাতা বানর’ও বলা হয়। Cercopithecidae গোত্রভুক্ত প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Trachypithecus pileatus। এ দেশের তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে এরা বিপন্ন বলে বিবেচিত।
পুরুষ মুখপোড়া হনুমানের দেহ ৬৮-৭০ সেন্টিমিটার, লেজ ৯৪-১০৪ সেন্টিমিটার এবং স্ত্রীর দেহ ৫৯-৬৭ সেন্টিমিটার, লেজ ৭৮-৯০ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ১১ দশমিক ৫ থেকে ১৪ এবং স্ত্রী ৯ দশমিক ৫ থেকে ১১ দশমিক ৫ কেজি। দেহের চামড়া কালচে। পিঠ ও দেহের ওপরের লোম গাঢ় ধূসর-বাদামি এবং বুক-পেট ও দেহের নিচ লালচে, লালচে-বাদামি বা সোনালি। লোমবিহীন মুখমণ্ডল, কান, হাত ও পায়ের পাতা কুচকুচে কালো। মাথার চূড়া ও লেজের আগাও কালো। চূড়া থেকে শক্ত কালো লোম এমনভাবে মাথা ঢেকে রেখেছে, মনে হবে যেন কালচে টুপি পরে রয়েছে।
মুখপোড়া হনুমান টাঙ্গাইলের পাতাঝরা বন এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এরা বৃক্ষচারী। চলাফেরা, খাবার সংগ্রহ, ঘুম, খেলাধুলা, বিশ্রাম, প্রজনন—সবকিছু গাছেই সম্পন্ন করে। শক্তপোক্ত একটি পুরুষের নেতৃত্বে দলের সব স্ত্রী, যুবক ও বাচ্চারা থাকে। এরা শান্তিপ্রিয়। দলবদ্ধ এই প্রাণীদের একেকটি দলে সচরাচর ২ থেকে ১৪টি প্রাণী থাকে।
এরা মূলত পাতাভোজী। গাছের কচি পাতা, বোঁটা, কুঁড়ি ও ফুল খায়। তবে বট, চালতা, আমড়া, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া ইত্যাদি ফলও বেশ পছন্দ। বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গাছের গর্ত ও পাতায় জমে থাকা পানি দিয়ে জলপান ও গোসল করে। সকাল-বিকেল-সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয়। দুপুরে বিশ্রাম নেয়। খেলাধুলা ও লাফালাফিতে ওস্তাদ। বাচ্চা বুকে নিয়ে মা সহজেই এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে পড়ে। এরা অনেকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের মতো করে ভুক ভুক শব্দ করে। অন্য কাউকে ভয় দেখাতে মুখে ভেংচি কাটে।
জানুয়ারি-এপ্রিল প্রজননকাল। স্ত্রী ১৮০-২২০ দিন গর্ভধারণের পর একটি, কদাচ দুটি বাচ্চার জন্ম দেয়। গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার বাচ্চা হয়। বাচ্চারা এক বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে ১৫-২০ বছর বাঁচে। বন-জঙ্গল ধ্বংসের কারণে দিনে দিনে এদের সংখ্যা যে হারে কমছে, তাতে এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিলে বিপন্ন এই প্রাণীটি অচিরেই হারিয়ে যাবে।