অযত্নে প্রত্ন নিদর্শনের বারোটা

প্রাচীন স্থাপত্য ও নানা পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ পাবনা জেলা। এখানে আছে সম্রাট আকবরের আমলে নির্মিত মসজিদ। প্রাচীন জমিদার আমলের বিভিন্ন মসজিদ-মন্দির, অট্টালিকা। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর এসব ভবন দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু এসব স্থাপনা সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কিছু স্থাপনায় ঝুলছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড।
জেলার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাবনা শহরসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। শহরের আবদুল হামিদ সড়কে আছে বিশ শতকে নির্মিত তাড়াশ ভবন। রাঘবপুর মহল্লায় আছে ১৬০৭ সালে নির্মিত জোড় বাংলা মন্দির। মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটা বসানো। ১৯ শতকে একই মহল্লায় নির্মিত হয় শীতলাই হাউস। ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয় ইলিয়ট ভবন। শহরের দিলালপুর মহল্লায় এ ভবনটিতে পাবনা সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে আছে সুদর্শন ভাড়ারা মসজিদ। কাছারিপাড়ায় আছে কাছারি মসজিদ।
জানা যায়, চাটমোহর উপজেলার পাঠানপাড়া মহল্লায় আছে সম্রাট আকবরের আমলে নির্মিত মাসুম খাঁ কাবুলীর শাহী মসজিদ। সমাজ গ্রামে আছে ১৫৪৯ সালে নির্মিত সমাজ শাহী মসজিদ। হান্ডিয়ালে আছে ১৫৫০ সালে নির্মিত জগন্নাথ মন্দির। এর পাশেই আছে শেঠের বাংলা নামে দোচালা আকৃতির পুরাকীর্তি। ফরিদপুর উপজেলায় আছে ফরিদপুর রাজবাড়ী, সাঁথিয়ায় তলট জমিদার বাড়ি, ঈশ্বরদী উপজেলায় নীল কুঠি, সুজানগরে দুলাই জমিদার বাড়ি, তাঁতিবন্ধ জমিদার বাড়ি, আটঘরিয়া উপজেলায় বেরুয়ান মসজিদ, গাড়ুরী মন্দিরসহ বিভিন্ন এলাকায় আরও কিছু প্রাচীন নিদর্শন আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ স্থাপনা অযত্ন-অবহেলায় আছে। বেশির ভাগ ভবনের চারপাশ অরক্ষিত। দেয়ালে বট-পাকুড়গাছ জন্মেছে। তারাশ ভবনের মূল সীমানাদেয়াল ভেঙে পড়েছে। ফটক ঢেকে আছে রাজনৈতিক দল ও সিনেমার পোস্টারে। ভেতরের মাঠ দখল করে করা হয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ। মূল ভবনের দেয়ালে থাকা টেরাকোটাগুলো খসে পড়ছে। তবে ভবনের ঠিক ওপরে টাঙানো আছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড। জোড় বাংলা মন্দিরের মাঠে খেলছে শিশুরা। মন্দিরের দেয়াল থেকে খসে পড়ছে টেরাকোটাগুলো। কিছু অংশ ভেঙে গেছে। এখানেও একপাশে ঝুলছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড। চাটমোহর শাহী মসজিদ ও হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দিরে গিয়েও চোখে পড়ে অযত্নের ছাপ। পুরাকীর্তি দুটোয় আছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড।
তাড়াশ ভবনের সামনে অবস্থিত শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আবদুল মতীন খান জানান, বহুদিন ধরে ভবনটিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড ঝুলছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই। ভবনে দায়িত্বরত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিরাপত্তাকর্মী মহসীন আলী বলেন, ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। একার পক্ষে এত বড় ভবনের চারপাশ খেয়াল রাখা সম্ভব হয় না। বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবনটি পরিদর্শন করে সংস্কার করার কথা বলেছেন। এখনো সংস্কার হয়নি।’
পাবনার সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাম দুলাল ভৌমিক জানান, অযত্ন-অবহেলায় দুলাইয়ের জমিদার বাড়ি, চাটমোহরের প্রমথ চৌধুরীর বাড়িসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু দর্শনীয় জমিদার বাড়ি ও পুরাকীর্তি ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও গবেষক এম আবদুল আলীম বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এসব সাক্ষী কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে। নতুন প্রজন্ম ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা সরকারের কাছে পুরাকীর্তিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বগুড়া কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে প্রচুর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন আছে। এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ ব্যয়সাপেক্ষ। এগুলোর তত্ত্বাবধানের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও অর্থ বরাদ্দও নেই। নিদর্শনগুলো সংস্কারের জন্য বিশেষভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের প্রয়োজন। তা-ও আমাদের নেই। এরপরও এখন আমরা ভালো বরাদ্দ পেয়েছি, যা দিয়ে কিছু সংস্কারকাজ শুরু করা হয়েছে। পাবনা তাড়াশ ভবন ও জোড় বাংলা মন্দির সংস্কারের জন্যও একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তা অনুমোদিত হলে কাজ শুরু করা হবে।’