ভ্যাটবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনে গতকাল রোববার আবারও অচল হয়ে গেল ঢাকা। সংঘর্ষ, লাঠিপেটা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা না ঘটলেও দিনভর জনদুর্ভোগ ছিল শহরজুড়ে। ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর রাজপথে নেমে এসে অবস্থান নেন।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও নারায়ণগঞ্জে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দিনভর বিক্ষোভ প্রদর্শন, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালনের পর গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা তাঁদের কর্মসূচি গতকালের মতো শেষ করেন। আজ আবার রাজপথে নামবেন বলে জানিয়েছেন।
গত বুধবার থেকে বিক্ষোভ-অবরোধ চললেও এর সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক ব্যাখ্যায় ছাত্রদের ভ্যাট দিতে হবে না বললেও শিক্ষার্থীরা তা বিশ্বাস করেননি। ভ্যাট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর নানা রকম মন্তব্য শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান দেশের বাইরে। সরকারের পক্ষে অন্য কাউকে এ ব্যাপারে আলোচনার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। পুলিশ সারা দিন উপস্থিত থাকলেও সড়ক চালু রাখতে বা জনদুর্ভোগ লাঘবে তাদের কোনো চেষ্টা ছিল না। অবশ্য পুলিশের শক্তি প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহল ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদের জানানো হয়েছে, আগামী তিন বছর শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাড়ানো হবে না। ভ্যাট পরিশোধ করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তিনি জানান, তাঁর শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ক্লাস করেছেন। রাজপথে বাইরের লোকদের সঙ্গে গুটি কয়েক ছাত্র যোগ দিয়েছেন। ইস্ট ওয়েস্ট ছাড়াও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে ভ্যাটের টাকা নিজেরাই পরিশোধ করবে বলে জানিয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনরত প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা জানিয়েছেন, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের সামনে ড্যাফোডিল, ইস্টার্ন ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। সাতমসজিদ সড়কের শঙ্কর এলাকায় স্টেট, স্টামফোর্ড ও ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটি; পান্থপথ-গ্রিন রোড এলাকায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, ভিক্টোরিয়া, অতীশ দীপঙ্কর ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা; রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা; নর্দ্দা-বসুন্ধরায় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি (আইইউবি) ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির; মহাখালীতে ব্র্যাক ও চেয়ারম্যানবাড়ি এবং কাকলী মোড়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ ইস্ট, সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া, রয়েল ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকায় উত্তরা ইউনিভার্সিটি, আইইউবিএটি, এশিয়ান, শান্ত-মারিয়াম, বিজিএমইএ ফ্যাশন ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও সাফরো ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে আশপাশের এলাকার সড়কগুলোতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে অবস্থানের কারণে ব্যস্ততম মিরপুর সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। একই অবস্থা কারওয়ান বাজার মোড় থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত। বিমানবন্দর সড়কও বন্ধ ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সকাল সাড়ে ১০টায় ধানমন্ডিতে প্রথমে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। এরপর মিরপুর থেকে নিউমার্কেট আসার পথে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেন। পরে বিপরীত পাশের সড়কও বন্ধ করে দেন তাঁরা।
কাকলী মোড়ে ও চেয়ারম্যানবাড়ি-সংলগ্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নেওয়ার কারণে বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তরায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
চার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ: শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈদের ছুটি ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল থেকে সেই ছুটি শুরু হলো। কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট নেবে না। ইতিমধ্যে ভ্যাট নেওয়া হলে তা পরের সেমিস্টারে সমন্বয় করা হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আজ সোমবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সহ–উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম রহমান জানান, আজ তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।
ভোগান্তির শিকার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও: যানবাহন না চলার কারণে অভিভাবকদের অনেকে রোদের মধ্যে শিশুদের নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। আর যাঁদের গাড়ি আছে, তাঁরা উপায় না দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতেই বসে থাকেন। কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা মুনিরা জাহান তাঁর শিশুকে নিয়ে পান্থপথ থেকে গুলশানে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন জরুরি কাজে। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে বাসায় ফিরে যান।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁরা রাস্তা ছাড়ছেন না।’
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, উত্তরায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক, গ্রিন রোড-পান্থপথ সড়ক, রামপুরা সড়ক, মিরপুর সড়ক, সাতমসজিদ সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখায় বেলা ১১টার পর থেকে সড়কগুলোতে তীব্র যানজট দেখা দেয়। ধানমন্ডি, কাকলী মোড় ও গ্রিন রোডের কাছে পুলিশ শিক্ষার্থীদের সড়কের এক পাশে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা চালালেও সফল হয়নি।
বনানীর কাকলী মোড়ে ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাখালীর ওয়্যারলেস মোড়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাকলী মোড়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া, রয়েল ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কয়েক শ শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় মহাখালী-বিমানবন্দর সড়ক ও বনানী-গুলশান-২ নম্বর লিংক রোড।
একই সময়ে মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় মহাখালী-ওয়্যারলেস-গুলশান-১ নম্বর রোড।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র শামীম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
ঢাকার বাইরে: চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্টসহ আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নগরের ওয়াসা মোড় অবরোধ করেন।
রাজশাহীতে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তালাইমারী ক্যাম্পাসের সামনে দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা ঢাকা-রাজশাহী সড়ক অবরোধ করেন। আর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টায় নগরের আলুপট্টি মোড়ে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। সিলেটে লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি ও নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কয়েক শ শিক্ষার্থী সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। বেলা ১১টার দিকে লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে সুরমা পয়েন্টে অবরোধ করেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনাঘাট এলাকায় অবস্থিত হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। খুলনায় নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নগরের শিববাড়ী মোড়ে মানববন্ধন করেন।
ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআর বিশ্ববিদ্যালয়কে ভ্যাট দিতে হবে বলে অদ্ভুত এক ব্যাখ্যা দিয়েছে। তিনি বলেন, এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও যে অভ্যাস ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হলো, তা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হবে।