হঠাৎ বিপর্যয়ে চার পরিবার

বর্বরতার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁরা। চেয়েছিলেন সুবিচার। আজ তাঁদের হত্যার বিচার চাইতে হচ্ছে পরিবারকে।

টাঙ্গাইলে মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের প্রতিবাদে গত শুক্রবার বিক্ষোভের সময় গুলি চালায় পুলিশ। এতে নিহত হন চারজন। উপার্জনক্ষম এই মানুষগুলোকে হারিয়ে হঠাৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে চারটি পরিবার।

গতকাল সোমবার ওই চারজনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, অন্যায়ের বিচার চাইতে গিয়ে প্রাণ দিতে হলো ওই চারজনকে। এই হত্যার বিচার চান তাঁরা।

গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ব্যক্তিদের একজন কালিহাতীর কুষ্টিয়া গ্রামের দিনমজুর ফারুক হোসেন (৩০)। গতকাল বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর ভাই মাসুম মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, দিনমজুরের কাজ করে ফারুকের সংসার চলত। তাঁর দুটি ছোট ছেলে রয়েছে। ১২ বছর বয়সী বড় ছেলেটি মানসিক প্রতিবন্ধী। ফারুক ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মাসুম মিয়া বলেন, ‘অন্যায়ের বিচার চাইতে গিয়ে আমার ভাই গুলিতে মারা গেছেন। এখন তাঁর পরিবারের কী হবে তা ভেবে পাচ্ছি না।’

সালেঙ্কা গ্রামের শামীম হোসেন (৩২) সেদিন কালিহাতীতে বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। টাঙ্গাইল মেডিকেল কালেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান।

শামীমের বাড়ি গিয়ে জানা যায়, তাঁর আট ও তিন বছর বয়সী দুটি সন্তান রয়েছে। ধানের ছোট ব্যবসা করতেন। এতে সংসারের সচ্ছলতা না আসায় সৌদি আরব যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। টাকা-পয়সা জমা দেওয়া হয়েছে। ঈদের পরই যাওয়ার কথা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শামীমের স্ত্রী বিথী আক্তার বললেন, ‘এখন আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে। কীভাবে চলবে আমাদের আগামী দিন।’

দক্ষিণ সালেঙ্কা গ্রামের শ্যামলচন্দ্র দাস ছিলেন সেলুনকর্মী। তাঁর বাবা রবি দাস জানান, সেদিন দোকানের কাজ শেষে চাল কিনতে গিয়েছিলেন শ্যামল। তখন বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে গুলিতে নিহত হন।

রবি দাস বলেন, তাঁদের কোনো জায়গা-জমি নেই। সরকারি জায়গায় ছোট একটি ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস করেন।

রবি দাসের প্রতিবেশী শহিদুর রশিদ বলেন, নিহত শ্যামলের ছোট দুটি ভাই রয়েছে। বাবার আয়ে সংসার চলে না। তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি সেলুনে কাজ করতেন। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখন দিশেহারা।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুই দিন পর গত রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান রুবেল ইসলাম (২০)। দক্ষিণ বেতডোবা গ্রামের গরু ব্যবসায়ী ফারুকুল ইসলামের বড় সন্তান রুবেল কালিহাতী কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। বাবার আয়ে সংসার চলে না। তাই লেখাপাড়ার পাশাপাশি একটি মুঠোফোনের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু রানী প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্বরোচিত একটি নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন সাধারণ মানুষকে জীবন দিতে হলো। তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

কালিহাতী কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সহসভাপতি বাদল মাহমুদ বলেন, ‘উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলো বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য ভবিষ্যতে চলার মতো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’