পুলিশ বরখাস্ত বা প্রত্যাহার, কোনো শাস্তি হতে পারে না

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে যুবক ছেলের সামনে তাঁর মাকে বিবস্ত্র করে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে নজিরবিহীন। ওই ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের মিছিল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু পুলিশ সেখানে বিনা উসকানিতে গুলি করেছে। এমন গুরুতর অপরাধের জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত বা প্রত্যাহার কোনো শাস্তি হতে পারে না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এই চিঠিটি দেওয়া হয়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি কার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, সেটাসহ চারটি বিষয় তদন্ত করার নির্দেশনা ও অনুরোধ জানানো হয়।
গত সোমবার মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে এই চিঠি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। নারকীয় এ ঘটনা জানার পর পুলিশ নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা এবং দুজনকে গ্রেপ্তারও করে। ঘটনার বিচার চেয়ে মানুষের মিছিল ও মানববন্ধন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ নির্বিচারে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে চারজনকে হত্যা এবং ২৫ জনকে আহত করে। কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ ঘটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাননি। এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে মোবাইল ফোনে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, এ-জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
এ ঘটনায় অবশ্য কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম ও ঘাটাইল থানার ওসি মোখলেসুর রহমানসহ আরও সাত পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার কমিশন এতে সন্তুষ্ট নয়। কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, ‘এমন গুরুতর অপরাধের জন্য সাময়িক বরখাস্ত বা প্রত্যাহার কোনো শাস্তি বলে গণ্য হতে পারে না; বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে পারত। কিন্তু তা না করে আট-নয় শ সাধারণ মানুষকে আসামি করে পুলিশ দুটি মামলা করেছে। পুলিশের এই উচ্ছৃঙ্খল-মারমুখী আচরণ কেবল পুলিশ বাহিনী নয়, সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছে।’
চিঠিতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।
ওই চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন মা ও সন্তান—এই দুজনের সঙ্গে টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাশালী দুর্বৃত্তরা যা করেছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে কখনো কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। গ্রিক রূপকথা ইডিপাসের ঘটনাটাই আমার শুধু মনে পড়ছে। বাস্তবে যে এমন জঘন্য, ঘৃণ্য ঘটনা ঘটতে পারে, ভাবা যায় না।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু পুলিশ কোনো ধরনের আইনি তোয়াক্কা না করে ঠান্ডা মাথায় গুলি করল? কে এই গুলির নির্দেশ দিল? মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আমি এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি।’
রুবেলের দাফন, প্রতিবাদ সমাবেশ: প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, কালিহাতীতে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে এবং মা ও ছেলে নির্যাতনকারীদের বিচারের দাবিতে গতকাল টাঙ্গাইলে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে জেলা মহিলা পরিষদ।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি বেগম শামছুন্নাহার শান্তি, মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার জেলা সমন্বয়কারী আতাউর রহমান আজাদ, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহনাজ খান, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু রানী প্রামাণিক, সেবকের নির্বাহী পরিচালক নাজমুছ সালেহীন প্রমুখ।
গত শুক্রবারের ঘটনায় নিহত রুবেলের দাফন সোমবার রাতে সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশের গুলিতে আহত রুবেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত রোববার তিনি মারা যান।

আরও পড়ুন